বিশিষ্ট বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক ও সম্পাদক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

হরপ্রসাদ মিত্র তার সম্পর্কে বলেছিলেন, “তাঁকে বুঝতে হলে তাঁর কালের সেন্টিমেন্ট উপেক্ষা করা চলবে না”। সামাজিক ভাঙন আর অবক্ষয়ের পটভূমিতে নতুন সমাজ গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিল কল্লোল গোষ্ঠী, তার পুরোভাগে ছিলেন তিনি।

বলছিলাম রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের পরে সাহিত্যজগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কল্লোল যুগের লেখকদের মধ্যে অন্যতম অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত সমন্ধে যিনি ছিলেন একাধারে বিশিষ্ট বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক ও সম্পাদক।

উনিশশো তিন সালের উনিশে সেপ্টেম্বর বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালী শহরে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর জন্ম হয়। তবে তাঁদের পরিবারের আদি নিবাস ছিল বর্তমান বাংলাদেশের মাদারিপুর জেলায়। তাঁর বাবা রাজকুমার সেনগুপ্ত ছিলেন নোয়াখালী আদালতের আইনজীবী৷ তিনি উনিশশো চব্বিশ সালে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ বি. এ.  পাশ করে, উনিশশো ছাব্বিশ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম. এ ডিগ্রী লাভ করেন৷  পরবর্তীকালে উনিশশো আঠাশ সালে বি. এল ডিগ্রী লাভ করেছিলেন তিনি৷

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ‘নীহারিকা দেবী’ নামে তাঁর কর্মজীবন তথা লেখক জীবনের সূত্রপাত করেন৷ তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রায় সকল ঘরানার ক্ষেত্রে নিজস্ব অবদান রেখেছিলেন।  তবে তাঁর উপন্যাস এবং ছোট গল্পের জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে আছেন। সব মিলিয়ে তিনি শতাধিক বই লিখেছেন। 

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত উনিশশো পঁচিশ সালে কল্লোল পত্রিকা প্রকাশনার দায়িত্ব নেন। কল্লোলের পাতায় আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল অসংখ্য সাহিত্যিকের। তাঁদের ভিতরে যাঁরা অগ্রগণ্য, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অচিন্ত্যকুমার। কল্লোলের সময়কাল ও অভিজ্ঞতা নিয়ে পরবর্তী কালে অচিন্ত্যকুমার ‘কল্লোলযুগ’ নামে একটি বইও লেখেন। 

অচিন্ত্যকুমারের চারটি জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ অমাবস্যা, আমরা, প্রিয়া ও পৃথিবী, নীল আকাশ। তবে এই কাব্যসৃষ্টিতে প্রকাশ ও বিষয়বস্তুতে নতুন কোনও ভাষা বা প্রকাশভঙ্গি পাওয়া যায় না তবুও তাঁর অনেক কবিতা জনপ্রিয় হয়েছিল৷ 

কর্মসূত্রে তাঁকে বাংলার বহু জায়গায় ঘুরতে হয়েছিল,শহরের কানাগলি থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের মেঠোপথে। সেই সময়ে খুব কাছ থেকে প্রকৃতি ও মানুষের সংস্পর্শ লাভ করেছিলেন তিনি৷ ফলে লেখকের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে। তাঁর  অভিজ্ঞতায় সাধারণ মানুষের জীবনকথাকে ছোটগল্প আর উপন্যাসে জায়গা দিয়েছেন বারবার। 

অচিন্ত্যকুমারের গল্পে অসংখ্য চরিত্রের ভিড় মুদি দোকান চালানো বিহারি মেয়ে গুড়িয়া, চাষী আমানত আলি, গায়িকা শেফালি, হাঁপানি রুগি অমর, পেশাদার সাক্ষী দুর্লভ প্রত্যেকেই নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর। 

দুই বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী হতাশা, আদর্শের অভাব প্রভৃতি যুগলক্ষণ তাঁর গল্পের পাতায় পাতায় মিশে রয়েছে। 

ছোটগল্প সম্পর্কে অচিন্ত্যকুমার বলেছিলেন, “ছোটগল্প লেখবার আগে চাই ছোটগল্পের শেষ। কোথায় সে বাঁক নেবে কোন কোণে, শেষ না পেলে ছোটগল্পে আমি বসতেই পারব না। শুধু ঘটনা যথেষ্ট নয়, শুধু চরিত্র যথেষ্ট নয়। চাই সমাপ্তির সম্পূর্ণতা”।

লেখকের এই ভাবনার জন্যই হয়ত অচিন্ত্যকুমারকে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন বিষ্ণু দে। 

তেরোশো তেত্রিশ বঙ্গাব্দে কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত ‘বেদে’। কবির কলমে লেখা উপন্যাস ‘বেদে’ প্রকাশিত হওয়ার পরে সাহিত্যজগতে এক আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এই উপন্যাসটি ছ’টি খণ্ডে বিভক্ত এবং প্রত্যেকটি খণ্ডে একজন করে নায়িকার কথা আছে। তারা সকলেই বীরনায়কের প্রতিরূপ। 

রবীন্দ্রনাথকে ‘বেদে’র এক কপি পাঠানো হয়েছিল তাঁর মতামতের জন্য। তিনি লিখেছিলেন,”আমি তোমার প্রতিভাকে উপলব্ধি করেছি।” 

বেদে’র পরবর্তী উপন্যাস ‘আকস্মিক’। গণিকা জীবনই এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। অচিন্ত্যকুমারের ‘আসমুদ্র’ উপন্যাসটিও পাঠক এবং সমালোচকের দ্বারা আদৃত। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে আরও আছে ছিনিমিনি, ইন্দ্রাণী, তৃতীয় নয়ন, তুমি আর আমি। 

উপন্যাসের চেয়েও ছোটগল্পে কথাসাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমারের সিদ্ধি আরও অনেক বেশি। উপন্যাসে যেমন ‘বেদে’, ছোটগল্পে তেমনই ‘দুইবার রাজা’ অচিন্ত্যকুমারকে প্রথম সাফল্য এনে দিয়েছিল৷ তাঁর পরবর্তী গল্প ‘অরণ্য’ একান্নবর্তী ও আত্ম-স্বাতন্ত্র্যপ্রিয় নরনারীর মানস বিশ্লেষণ।

সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত উনিশশো পঁচাত্তর সালে জগৎ্তারিণী পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার ও শরৎচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন।

উনিশশো ছিয়াত্তর সালের আজকের এই দিনে অর্থাৎ উনত্রিশ জানুয়ারি কলকাতায় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের  মৃত্যু হয়। লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন এর সকল স্তরের সদস্য, দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে গুণী এই মানুষের মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই অজস্র ভালোবাসা এবং বিনম্র শ্রদ্ধা।

তারিখঃ- ২৯/১/২০২১ ইং।

Facebook Comments