বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক অভিজিৎ সেনের জন্মবার্ষিকী আজ

উপন্যাসে একটি নারী ও একটি পুরুষ প্রধান চরিত্রের প্রথাগত ধারণাকে ভেঙে যিনি গোষ্ঠীগত চারিত্রদান করে কেন্দ্রীয় চরিত্রে একক নয় বহুমাত্রিক বহুব্যক্তিক অভিঘাত তৈরি করে একক লক্ষ্য স্থাপন করেন তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র অভিজিৎ সেন।

অভিজিৎ সেন জন্মগ্রহণ করেছিলেন উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালের আটাশে জানুয়ারী, তৎকালীন বরিশাল জেলার ঝালকাঠি মহকুমার কেওড়া গ্রামে। উনিশশো পঞ্চাশ এর দশকের শুরুতে তিনি কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তিনি কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রাম, তারপরে পুরুলিয়া এবং তারপরে আবার কলকাতায় যাওয়ার সময় একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর উচ্চ বিদ্যালয় এবং কলেজ-স্তরের শিক্ষার কিছু অংশ শেষ করেছেন। শেষ পর্যন্ত কলকাতার একটি বীমা সংস্থায় চাকরি করার সময়, তিনি ইতিহাসে স্নাতক এবং স্নাতক উভয়ই ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।

উনিশশো উনসত্তর সালে তিনি বিপ্লবী নকশাল আন্দোলনে যোগ দিতে কলকাতায় চাকরি, পারিবারিক জীবন এবং আধিপত্য বিসর্জন দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে মালদহে কিছু বছর থাকার পরে তিনি সম্প্রতি কলকাতায় চলে এসেছেন। 

তাঁর গল্পের বেশিরভাগ চরিত্রই তাঁর জীবনের প্রত্যক্ষ ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে আঁকা।

নিরীক্ষাভাবনায় তার স্বাতন্ত্র্য লক্ষণীয়।তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘রোহু চন্ডালের হাড়’ যা উনিশশো পঁচাশি সালে প্রকাশিত হয়েছিল। নিরীক্ষাপ্রিয় এই ভাষাচিত্রীর প্রথম উপন্যাস রহু চণ্ডালের হাড় বাংলা উপন্যাসের ধারায় একটি বিশেষ সংযোজনা- একমুখী ঘটনা ও কেন্দ্রীয় চরিত্রের প্রথাগত ধারণাকে ভেঙে এই উপন্যাসেই তিনি বিনির্মাণ করলেন বহু চরিত্রের একমুখী ডাইমেনশন। উত্তরবঙ্গের এক যাযাবর গোষ্ঠীর জীবন সংগ্রামের কাহিনী- এই কাভারেজটি প্রথম সংস্করণে ব্যবহৃত হলেও পরে আর ব্যবহৃত হয়নি।

অপরদিকে ‘স্বপ্ন এবং অন্যান্য নীলিমা’ উপন্যাসটি একাত্তরের পটভূমি নিয়েই লেখা। আনোয়ার পাশা রাইফেল-রোটি-আওরাত একাত্তরের উত্তাল-দুঃসহ সময়ের কাহিনীচিত্র, পক্ষান্তরে স্বপ্ন এবং অন্যান্য নীলিমা সীমান্তবর্তী শরণার্থী শিবিরের কাহিনী চিত্র। একাত্তরে বাঙালি দিশেহারা হয়ে যখন ভারতমুখী তখন মানিক কলকাতা থেকে বালুরঘাটমুখী হয়। কারণ রাজনৈতিক পরিচয়টি তাকে আততায়ী পরিচয় সেটে দেয়। মানিক পালিয়ে মাঝের বন্দর আসে এবং পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্যাতিত-নিপীড়িত হেনাদের পরিবারও মাঝের বন্দর আশ্রয় নেয়। দুটি ঘটনাই নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার। মাঝের বন্দর উত্তরবাংলার বিভিন্ন স্থানের নামকরণের সঙ্গে মেলে, পশ্চিমবাংলার দক্ষিণ দিনাজপুরে মাঝের বন্দরের অবস্থান, বাংলাদেশে চিরিরবন্দর, রাণীরবন্দর, পুরাতন বন্দর। অপ্রয়োজনীয় কিন্তু প্রসঙ্গত উল্লেখ্য প্রবন্ধকারের জন্মস্থান পুরাতন বন্দরে। 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যধারায় স্বপ্ন এবং অন্যান্য নীলিমা উপন্যাসটি তাই বিশেষ স্থান দখল করে থাকবে।

রাজপাট ধর্মপাট উপন্যাসটি শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে। ইতিহাসকে আশ্রয় করে অভিজিৎ সেন শ্রীচৈতন্যকে মানবিক করে তুলেছেন। ধর্মপ্রচারক শ্রীচৈতন্যদেবের ধর্ম প্রচারণার বাইরে রাজনৈতিক দুরদর্শিতাকে খুব সূক্ষভাবে তুলে আনতে পেরেছেন। সমগ্র ভারতবর্ষকে একই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মানবিক ছায়াতলে নিয়ে আসার এক প্রাণান্ত প্রচেষ্টা দেখা যায়। পরিব্রাজক হয়ে শ্রীচৈতন্যদেব যে রাজনৈতিক দর্শনকে লালন করে তাকে প্রোথিত করে ধর্মান্ধতার বাইরে নিরপেক্ষ দৃষ্টি রেখে তিনি শ্রীচৈতন্যদেবকে এঁকেছেন মানবীয় গুণাবলীর এক ঐশ্বর্যশালী ক্ষমতাবান পুরুষ হিসেবে।

তবে সবকিছুকেই ছাপিয়ে গিয়েছে তার প্রথম সৃষ্টি  রোহু চন্ডালের হাড় উপন্যাসটি।এটি উনিশশো বিরানব্বই সালে ম্যাজিক বোনস হিসাবে ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে (অভিনব পাবলিকেশনস দিল্লি এবং ফেসবুক বুকস ইন্টারন্যাশনাল নিউইয়র্ক যৌথভাবে প্রকাশিত)। আবার উনিশশো বিরানব্বই সালে এই উপন্যাসের জন্য তিনি বঙ্কিমচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছিলেন।

দুইহাজার পাঁচ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শরৎচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কারও পেয়েছিলেন।

আজ আঠাশে জানুয়ারি বাংলা সাহিত্যের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র অভিজিৎ সেনের জন্মবার্ষিকী। লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন এর সকল সদস্য, দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে উপন্যাসের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় প্রিয় লেখককে জানাই জন্মদিনের অনেক অনেক শুভকামনা, অজস্র ভালোবাসা এবং বিনম্র শ্রদ্ধা।

তারিখঃ- ২৮/১/২০২১ ইং।

Facebook Comments