বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের ১০৫ তম জন্মবার্ষিকী আজ

বন্দে মায়া লাগাইছে, কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি, বসন্ত বাতাসে সই গো, তুমি মানুষ আমিও মানুষ, প্রাণে সহে না দুঃখ বলবো কারে, কোন মেস্তোরি নাও বানাইছে, ওরে ভব সাগরের নাইয়াসহ অসংখ্য জনপ্রিয় বাউল গান ও গণসংগীতের রচয়িতা বাউল শাহ আব্দুল করিমের জন্মদিন আজ।

 

উনিশশো ষোল সালের আজকের এই দিনে অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলাধীন ধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

 

শাহ আবদুল করিম বাংলার লোকজ সংগীতের ধারাকে আত্মস্থ করেছেন অনায়াসে। ভাটি অঞ্চলের সুখ-দুঃখ তুলে এনেছেন গানে। নারী-পুরুষের মনের কথা ছোট ছোট বাক্যে প্রকাশ করেছেন আকর্ষণীয় সুরে। ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তাঁর গান কথা বলে সব অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে।

 

নানা অভাব-অনটন, দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা এ বাউল এক সময় সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা চষে বেড়িয়েছেন। আর কালে কালে মানুষের দুঃখ দুর্দশা দেখে তা নিয়ে গান রচনা করে গেছেন। এই গানে যেমন ছিল আনন্দ তেমনি ছিল জীবন সংগ্রামের প্রেরণা। আর এ কারণেই তাঁকে দেওয়া হয়েছে ‘বাউল সম্রাটের’ মর্যাদা।অনেক অভাব অনটনের মধ্যে বেড়ে উঠলেও গানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালবাসা।

 

শৈশব থেকেই একতারা ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। সাদাসিধে জীবন কেটেছে। বাউল ও আধ্যাত্মিক গানের তালিম নেন কমর উদ্দিন, সাধক রসিদ উদ্দিন, শাহ ইব্রাহিম মোস্তান বকসের কাছ থেকে।

তিনি তাঁর গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন প্রখ্যাত বাউলসম্রাট ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহের দর্শন থেকে।

 

জীবিকা নির্বাহ করেছেন কৃষিকাজ করে। কিন্তু কোনো কিছু তাঁকে গান সৃষ্টি করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।

 

অসংখ্য গণজাগরণের গানের রচয়িতা বাউল শাহ আব্দুল করিম অত্যন্ত সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন।

 

গানে-গানে অর্ধশতাব্দীরও বেশি লড়াই করেছেন ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে। এ জন্য মৌলবাদীদের দ্বারা নানা লাঞ্ছনারও শিকার হয়েছিলেন তিনি।

 

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, কাগমারী সম্মেলন, ভাষার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে মানুষকে প্রেরণা জোগায় শাহ আবদুল করিমের গান। গানের জন্য মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহচর্যও পেয়েছেন তিনি।

 

শাহ আবদুল করিম হাওরের ঢেউ আর কালনী নদীর স্রোত, গ্রামের সহজ-সরল মানুষের প্রাত্যহিক জীবন, দুঃখ-দুর্দশা, প্রেম-ভালোবাসাকে তুলে ধরেছেন তাঁর গানে। ছোট ছোট গল্প বুনে সৃষ্টি করেছেন কালজয়ী সব গান।

 

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও, তিনি ছিলেন স্ব শিক্ষিত। জীবদ্দশায় কালনী নদীর তীরে বসে তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য বাউল গান।

 

ভাটিবাংলার অপার সৌন্দর্য তিনি ধারণ করেছিলেন তাঁর হৃদয় সত্তায়। সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তাঁকে তিলেতিলে পীড়ন করতো। তাঁর গানে গ্রামবাংলার জীবনচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন সুনিপুণভাবে। গানে গানে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মানুষের আত্মার আত্মীয়, অকৃত্রিম দেশপ্রেমিক ও গণ মানুষের শিল্পী।

 

শাহ আব্দুল করিমের লেখা এবং সুর করা গানের সংখ্যা ১৫শ’র বেশি। বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর ১০টি কালজয়ী গান ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। এছাড়া তাঁর ৬টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সংগীত সাধনায় অসাধারণ অবদানের জন্য একুশে পদকসহ বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আড়াইশ’র বেশি পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন বাউল সম্রাট।

 

লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন এর সকল সদস্য, দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে প্রিয় বাউল সম্রাটের ১০৫ তম জন্মবার্ষিকীতে জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।

তারিখ:- ১৫/০২/২০২১ ইংরেজি

Facebook Comments