বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের কালজয়ী পথিকৃত জহির রায়হানের জন্মবার্ষিকী আজ

তিনি বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে এক প্রেরণার নাম। বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের কালজয়ী এক পথিকৃত ছিলেন। প্রগতিশীল ও প্রতিবাদী সাহিত্য চর্চা করতে করেতই একসময় তিনি চলচ্চিত্রকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে চলচ্চিত্রই হয়ে ওঠে তার ধ্যান-জ্ঞান।

বলছি বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা, ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার জহির রায়হানের কথা।তিনি বাঙালির এক ঐতিহ্য পুরুষ। সংস্কৃতি ও রাজনীতি অঙ্গনের এই কৃতি পুরুষের মূল পরিচয় সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার। রাজনৈতিক আদর্শে বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন বাঙালির এই বীর সন্তান। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসৈনিক, সাংবাদিক- সর্বোপরি একজন প্রতিবাদী মানুষ; যিনি ঐতিহ্যকে লালন করেছিলেন নিজের বিশ্বাসে বলীয়ান থেকে।

উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ উনিশে আগষ্ট তিনি ফেনী জেলার মজিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক এবং ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। জহির রায়হানের প্রকৃত নাম মোহাম্মদ জহিরউল্লাহ। তাঁর ডাক নাম ছিল জাফর। ছোটবেলাতেই তিনি রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন।

বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার ও বড় বোন নাফিসা কবির বাম ধারার রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের কাছ থেকেই জহির রায়হানের বামপন্থী চিন্তা-চেতনায় দীক্ষিত হন। তিনি কলকাতায় মিত্র ইনিস্টিউটে এবং পরে আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। ভারত বিভাগের পর তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিজ গ্রামে চলে যান।

উনিশশো পঞ্চাশ সালে তিনি আমিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হন।

একটা সময় ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা হয়। তিনি সচেতনভাবে যুক্ত হন ভাষা আন্দোলনের সাথে। উনিশশো বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আমতলা বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক যে দশ জনের দলটি প্রথম একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করে গ্রেপ্তার হন, জহির রায়হান ছিলেন তাঁদের অন্যতম। উনিশশো আটান্ন সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

এরই মধ্যে উনিশশো বায়ান্ন সালে তিনি ফটোগ্রাফি শিখতে কলকাতা গমন করেন এবং প্রমথেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল স্কুলে ভর্তি হন। উনিশশো ছাপান্ন সালে তিনি চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন।

উনিশশো একষট্টি সালে তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র কখনও আসেনি মুক্তি পায়। তারপর একের পর এক তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে থাকে। নিপুণ দক্ষতার সাথে চলচ্চিত্র নির্মাণ শিল্পে খুব অল্পসময়ে নিজেকে বিকশিত করেন জহির রায়হান। তাঁর নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রামাণ্য চিত্রগুলো যুদ্ধকালীন সময়ে বিশ্বমানবতার টনক নাড়িয়ে দেয়।

জহির রায়হানের নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো হলো- কখনো আসেনি, সোনার কাজল, কাঁচের দেয়াল, সংগ্রাম, বাহানা, বেহুলা, আনোয়ারা, দুই ভাই, জীবন থেকে নেয়া ও ইংরেজি ভাষায় Let There Be Light।

উনিশশো চৌষট্টি সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি) এবং পরের বছর তাঁর প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ মুক্তি দেন।

ব্যক্তিগত জীবনে জহির রায়হান উনিশশো একষট্টি সালে সুমিতা দেবীকে এবং উনিশশো ছেষট্টি সালে তিনি সুচন্দাকে বিয়ে করেন। দু’জনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। শমী কায়সার জহির রায়হানের বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের কন্যা।

তিনি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নামে একটি ইংরেজি ছবি নির্মাণ শুরু করেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তিনি তা শেষ করতে পারেননি। উনিশশো একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। সেখান থেকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গণহত্যার চিত্র সম্বলিত ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মাণ করেন। ছবিটি পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যতার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করেন।

‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের মধ্যে যেভাবে তিনি আবহমান বাংলার স্বকীয়তা ও ধারাবাহিকতাকে বেঁধেছেন, এক কথায় তা অসামান্য। বাংলা সাহিত্যে এমন কালজয়ী উপন্যাস খুব বেশি নয়।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে জহির রায়হানের লেখা ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ ও ‘আরেক ফাল্গুন”’ নামক উপন্যাস দুটি তাঁর অনবদ্য রচনা।

জহির রায়হানের উর্দু ছবি সঙ্গম ছিল পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গীন ছবি। তাঁর অপর উর্দু ছবি বাহানা ছিল সিনেমাস্কোপ।

‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের জন্য উনিশশো চৌষট্টি সালে ‘আদমজী পুরস্কার’ পান জহির রায়হান। উনিশশো বাহাত্তর সালে তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (মরণোত্তর) এবং উনিশশো সাতাত্তর সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
এছাড়া শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে ‘কাচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ‘নিগার পুরস্কার’ লাভ করেন।

তার অন্তর্ধানের দীর্ঘ আটাশ বছর পর্যন্ত তাকে অপহরণ করে গুম করে ফেলার খবর প্রচার করা হলেও পহেলা সেপ্টেম্বর উনিশশো নিরানব্বই দৈনিক ভোরের কাগজের এক রিপোর্টে বেরিয়ে আসে জহির রায়হান খুনের আসল রহস্য।

এরই মধ্য দিয়ে পুরো জাতি জানতে পারে উনিশশো বাহাত্তর সালের ত্রিশে জানুয়ারি বাংলার এই উজ্জ্বল নক্ষত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।

লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন এর সকল সদস্য দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে গুণী এই মানুষের জন্মবার্ষিকীতে জানাচ্ছি গভীর শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।

জহির রায়হান আজও স্মরণীয়, বরণীয় এবং বাঙালির স্মৃতিপটে অম্লান। তিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আজন্মের আলোকবর্তিকা; শিল্প-সৃজনে অনুপ্রেরণার এক সূতিকাগার। তাঁর অনবদ্য সৃজনালোয়ে তিনি উজ্জল হয়ে বেঁছে থাকবেন বাঙালির স্মৃতি-সত্তায়।

তারিখঃ- ১৯/৮/২০২১ ইং।

Facebook Comments