প্লেব্যাক সম্রাট কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

বাংলা গানের এই কণ্ঠশিল্পী ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের আধুনিক ও চলচ্চিত্রজগতের কালজয়ী অনেক গান তাঁর কণ্ঠে সমৃদ্ধ হয়েছে। সুখ দুঃখ, হাসি আনন্দ, প্রেম বিরহ সব অনুভূতির গানই তিনি গেয়েছেন।

রাজশাহীতে উনিশশো পঞ্চান্ন সালের চৌঠা নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এন্ড্রু কিশোর। বাবা ক্ষীতিশ চন্দ্র বাড়ৈ। মা রাজশাহীর বুলনপুর মিশন গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষিকা মিনু বাড়ৈ। মায়ের কাছেই তার পড়াশোনায় হাতেখড়ি।

মা মিনু ছিলেন সংগীত অনুরাগী মানুষ। তার পছন্দের গায়ক ছিলেন কিশোর কুমারের ভক্ত। তাই কিশোর কুমারের নাম অনুযায়ী এন্ড্রু কিশোরের নাম রাখেন ‘কিশোর কুমার বাড়ৈ’।

মায়ের ইচ্ছা ছিল কিশোর কুমারের মতো তার ছেলেও একদিন নাম করবে। মায়ের ইচ্ছাতেই রাজশাহীর আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে সংগীতে প্রথম পাঠ শুরু করেন তিনি।

সত্তর দশকের শেষ দিকে প্লেব্যাকের জগতে পা রাখেন এন্ড্রু কিশোর। বাংলা ছায়াছবির গানসহ হিন্দি সিনেমায় গান গেয়ে বেশ প্রশংসিত হয়েছেন এই নন্দিত সংগীত শিল্পী।

এন্ড্রু কিশোরের সার্টিফিকেটের নাম এন্ড্রু কিশোর ছিল না। ছিল এন্ড্রু কিশোর কুমার বাড়ৈ। গান করতে এসে তিনি সেই নাম ছোট করে এন্ড্রু কিশোর করেন তিনি নিজেই।

তিনি রাজশাহী সরকারী সিটি কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব কমার্স সুসম্পন্ন করেন এবং পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, আধুনিক, লোকসংগীত, দেশাত্মবোধকসহ প্রায় সব ধারার গানে কণ্ঠ দেন রাজশাহী বেতারে তালিকাভুক্ত সংগীতশিল্পী হিসেবে।

চলচ্চিত্রে এন্ড্রু কিশোর গান গাওয়া শুরু করেন উনিশশো সাতাত্তর সালে। মেইল ট্রেন ছবিতে তিনি গেয়েছিলেন ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানটি। চলচ্চিত্রে এটাই ছিল তাঁর প্রথম গান।

কিন্তু এন্ড্রু কিশোর সবার কাছে পৌঁছে যান দুই বছর পর। তাঁর গানটি ছিল ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’।

মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা গানটির সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন আলম খান।

দীর্ঘদিন পুরোদস্তুর পেশাদার কণ্ঠশিল্পী হিসেবে দুই বাংলায় গান করেছেন এন্ড্রু কিশোর। একের পর এক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন তিনি।

প্রয়াত সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হকের লেখা শেষ তিনটি গান তিনি গেয়েছেন আলম খানের সুর সংগীতে।

এন্ড্রু কিশোর দেশের প্রখ্যাত সুরকারদের মধ্যে বেশি গান করেছেন আলম খান, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আলাউদ্দিন আলীর সঙ্গে। এ ছাড়া গান করেছেন শেখ সাদী খান, ইমন সাহা, আলী আকরাম শুভসহ অনেকের সঙ্গে।

ভারতের প্রখ্যাত সুরকার আর ডি বর্মণের সুরেও গান গেয়েছেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে কলকাতাতেও প্লেব্যাকে বেশ কয়েকটি গান করেছেন তিনি।

মাঝে কিছুদিন ব্যবসাও করেছিলেন। এন্ড্রু কিশোর উনিশশো সপ্তাশী সালে আহমাদ ইউসুফ, আনোয়ার হোসেন বুলু, ডলি জহুর প্রমুখের সঙ্গে টিভি নাটক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য প্রযোজনার জন্য ‘প্রবাহ’ নামে একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান শুরু করেন।

এন্ড্রু কিশোরের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে জীবনের গল্প/ আছে বাকি অল্প, হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস, ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, আমার বুকের মধ্যিখানে, তুমি যেখানে/ আমি সেখানে, সবাই তো ভালোবাসা চায়, চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা, বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে, তুমি আমার জীবন/ আমি তোমার জীবন, ভালো আছি ভালো থেকো, ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা, ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না, তুমি আমার কত চেনা, তুমি মোর জীবনের ভাবনা, তোমায় দেখলে মনে হয়, এইখানে দুইজনে নির্জনে’সহ অনেক গান।

জীবনের বেশির ভাগ সময়ে মূলত চলচ্চিত্রে গান করেই কাটিয়েছেন। চলচ্চিত্রে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে অডিও বাজারে খুব একটা অ্যালবাম করেননি।

চলচ্চিত্রের বাইরে এসে প্রথম দিকে তিনি ‘ইত্যাদি’তে গান করেন ‘পদ্মপাতার পানি নয়’, যা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীকালেও বেশ কয়েকবার ‘ইত্যাদি’তে এসেছেন।

চৌষট্টি বছর বয়সে আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ দুই হাজার বিশ সালের ছয় জুলাই রাজশাহীতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সকল সদস্য দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে তার মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।

তাংঃ- ৬/৭/২০২১ ইং।

Facebook Comments