স্বর্গ এক উপসর্গ, ফল তাহে কলা।
দিবানিশি পড়ে থাকি, ধরে তোর গলা॥
চারি পায়ে ছাদ দিয়া, তুলে রাখি বুকে।
হাতে হাতে স্বর্গ পাই, বোকা গন্ধ সুঁকে॥
শুধু যায় পেট ভরে, পাঁঠারাম দাদা।
ভোজনের কালে যদি, কাছে থাকো বাঁধা।
শাদা কালো কটারূপ, বলিহারি গুণে।
সাত পাত ভাত মারি, ভ্যাঁ ভাঁ রব শুনে॥
মহিমায় নাম ধর, শ্রীমহাপ্রসাদ।
তোমার প্রসাদে যায়, সকল বিষাদ॥
জ্বাল দিতে কাল যায়, লোল পড়ে গালে।
কাটনা কামাই হয়, বাটনার কালে॥
ইচ্ছা করে কাঁচা খাই, সমুদয় লোয়ে।
হাড়শুদ্ধ গিলে ফেলি, হাড়গিলে হয়ে॥
মজাদাতা অজা তোর কি লিখিব যশ?
যত চুষি তত খুশি হাড়ে হাড়ে রস॥
গিলে গিলে ঝোল খায় আম্বাদনহত।
তাদের জীবন বৃথা দাঁতপড়া যত॥
এমন পাঁঠার মাস নাহি খায় যারা।
মরে যেন ছাগী-গর্ভে জন্ম লয় তারা॥
দেখিয়া ছাগের গুণ করে অভিমান।
হইলেন বরারূপ নিজে ভগবান॥
কবিতাঃ-পাঁঠা
(ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)
ব্যঙ্গ-বিদ্রূপই ছিল তাঁর রচনার বিশেষত্ব। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের এ ভঙ্গি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন কবিয়ালদের নিকট থেকে। ব্যঙ্গের মাধ্যমে অনেক গুরু বিষয়ও তিনি সহজভাবে প্রকাশ করতেন।
বলছি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যুগসন্ধির কবি হিসেবে পরিচিত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কথা।
পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার কাঞ্চনপল্লী বা কাঁচড়াপাড়া গ্রামে আঠারোশো বারো সালের আজকের এই দিনে অর্থাৎ ৬ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সহিত্যের অন্যতম প্রধান একজন কবি লেখক ঈশ্বরচন্দ্র দাশগুপ্ত।
দশ বছর বয়সে মাতৃবিয়োগের পর ঈশ্বরচন্দ্র জোড়াসাঁকোয় মাতুলালয়ে আশ্রয় নেন। শৈশবে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হওয়ার কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি তবে অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তির অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র নিজ চেষ্টায় বাংলা,সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষা শেখেন এবং বেদান্তদর্শনে পারদর্শিতা লাভ করেন।
পরে তিনি সংবাদ প্রভাকরে সংযুক্ত হয়েছিলেন।
আধুনিক বাংলার সমাজ গঠনে সংবাদ প্রভাকরের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বরচন্দ্র প্রথমে নব্যবঙ্গ আন্দোলনের বিরুদ্ধে রক্ষণশীলদের পক্ষভুক্ত ছিলেন। তিনি হিন্দু কলেজের শিক্ষাপদ্ধতিরও বিরোধিতা করেছিলেন।
কিন্তু নবপর্যায়ে সংবাদ প্রভাকর সম্পাদনার সময় থেকে তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন হতে থাকে। তিনি দেশের প্রগতিশীল ভাবধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন।
প্রথম দিকে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরোধিতা করে এ বিষয়ে নানা ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করলেও পরে স্ত্রীশিক্ষার সমর্থন, ধর্মসভার বিরোধিতা, দেশের বৈজ্ঞানিক ও বাণিজ্যিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা এবং দরিদ্র জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে উদার মনোভাবের পরিচয় দেন।
ঈশ্বরচন্দ্রের ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার ছিল মধ্যযুগীয় যদিও তিনি সমকালের সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করেন।
মঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্রের সাহিত্যাদর্শ যখন লুপ্ত হয়ে আসছিল, তখন তিনি বিভিন্ন বিষয় অবলম্বনে খন্ডকবিতা রচনার আদর্শ প্রবর্তন করেন।
স্বদেশ ও স্বসমাজের প্রতি ঈশ্বরচন্দ্রের অনুরাগ ছিল অত্যন্ত নিবিড়। তিনি বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য যে আন্দোলন করেছেন তা আজ স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি সবসময় ইংরেজি প্রভাব বর্জিত খাঁটি বাংলা শব্দ ব্যবহার করতেন। ভাষা ও ছন্দের ওপর তাঁর বিস্ময়কর অধিকারের প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর বোধেন্দুবিকাশ নাটকে।
ঈশ্বরচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো ভারতচন্দ্র রায়, রামপ্রসাদ সেন, নিধুগুপ্ত, হরু ঠাকুর ও কয়েকজন কবিয়ালের লুপ্তপ্রায় জীবনী উদ্ধার করে প্রকাশ করা।
পরবর্তীকালের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকের জন্য একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করার কৃতিত্বও তাঁর।
যদিও ঈশ্বরচন্দ্রের কাব্যরীতি পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্যে আর অনুসৃত হয়নি, তথাপি এ কথা স্বীকার্য যে, ভবিষ্যৎ বাংলা সাহিত্যের জন্য তাঁর গঠনমূলক চিন্তাভাবনা ও আদর্শ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
ঈশ্বচন্দ্র গুপ্ত ছোটবেলা থেকেই মুখে মুখে কবিতা রচনা করতেন এবং কবিয়ালদের গান বেঁধে দিতেন। সমসাময়িক ঘটনাকে ব্যঙ্গ করে তিনি অসংখ্য খন্ডকবিতা সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশ করেন। উনিশ শতকের প্রথম ভাগের এ কবি স্বদেশমূলক যেসব কবিতা রচনা করেছেন তার জন্যও তিনি বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
আজ প্রিয় কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জন্মবার্ষিকীতে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সকল দায়িত্বশীল সদস্য এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।
তারিখ:- ০৬/০৩/২০২১ ইংরেজি