আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একজন কথাসাহিত্যিক। সংখ্যার দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে খুবই কম লিখেছেন তিনি। দু’টি উপন্যাস, গোটা পাঁচেক গল্পগ্রন্থ আর একটি প্রবন্ধ সংকলন এই নিয়ে তাঁর রচনাসম্ভার।
বাস্তবতার নিপুণ চিত্রণ, ইতিহাস ও রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ তাঁর রচনাকে দিয়েছে ব্যতিক্রমী সুষমা।
বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ’র পরেই তিনি সর্বাধিক প্রশংসিত বাংলাদেশি লেখক।
আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস ১৯৪৩ সালের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলায়।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন।
তার কর্মজীবন শুরু হয় জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক পদে যোগদানের মাধ্যমে। এর পর তিনি মিউজিক কলেজের উপাধ্যক্ষ, প্রাইমারি শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরিচালক, ঢাকা কলেজের বাংলার প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেন, গোপনে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তাঁর লেখা প্রতিশোধ, অন্য ঘরে অন্য স্বর, খোঁয়ারি, মিলির হাতে স্টেনগান, অপঘাত, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, রেইনকোট প্রভৃতি গল্পে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতা।
ইতিবাচক রাজনীতির উপস্থাপনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অব্যবহিত পূর্বরূপটি উপস্থাপনে ‘চিলেকোঠার সেপাই’ একটি অনন্য উপন্যাস।
ছোট ছোট কাহিনীপর্বকে সুন্দর সম্মিলনের মাধ্যমে এ উপন্যাসে একটি মহাকাব্যিক রূপ দিয়েছেন। শহরের বস্তি থেকে শুরু করে যমুনার দুর্গম চর এলাকা পর্যন্ত উপন্যাসটি বিস্তৃত হয়েছে। লেখকের অতি সূক্ষ্ম এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ শক্তিতে উপন্যাসের শব্দে শব্দে একটি আলাদা দ্যোতনা সৃষ্টি হয়েছে। লেখকের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লেখায় একেকটি চরিত্রের বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, ঘটনার সাথে চরিত্রের বাস্তবতা, কল্পনা, চেতনা অন্তঃচেতনার মিশ্রণে প্রতিটি পৃষ্ঠায় পাঠক নতুন দৃষ্টিতে জীবনকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। উপন্যাসের কাহিনীবিন্যাসই পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়।
তাঁর উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাই থেকে খোয়াবনামা একেবারেই ভিন্ন মেজাজের। কারণ তিনি গতানুগতিক ধারায় সাহিত্য-রচনা করতে চাননি। তিনি মনে করতেন একই বৃত্তে ঘুরপাক খেলে প্রকৃত শিল্পীসত্তা গড়ে ওঠে না। তাই তিনি গল্প-উপন্যাসে সমাজের রূপান্তর ঘটাতে চেয়েছেন। খোয়াব শব্দের অর্থ স্বপ্ন। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। কল্পনা বা স্বপ্ন নিয়েই মানুষ প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় ছুটে বেড়ায়। বিপন্ন মানুষের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।
পাঁচটি গল্পের বই আছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের। অন্য ঘরে অন্য স্বর, খোঁয়ারি, দুধভাতে উত্পাত, দোজখের ওম, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল নামে। সংস্কৃতির ভাঙা সেতু নামে তাঁর প্রবন্ধের বইটিও খুব উঁচুমানের।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এদেশের প্রগতিশীল ও মানবতাবাদী সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতিও তাঁর পরোক্ষ সমর্থন ছিল। তিনি কথাসাহিত্যিক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর লেখায় সমাজবাস্তবতা ও কালচেতনা গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বিশেষত, তাঁর রচনাশৈলীর ক্ষেত্রে যে স্বকীয় বর্ণনারীতি ও সংলাপে কথ্যভাষার ব্যবহার লক্ষণীয় তা সমগ্র বাংলা কথাশিল্পে অনন্যসাধারণ।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন। সেগুলো হলো হুমায়ুুন কবির স্মৃতি পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, সাদাত আলী আখন্দ পুরস্কার, কাজী মাহবুবুল্লাহ স্বর্ণপদক ও একুশে পদক (মরণোত্তর)।
উনিশশো সাতানব্বই সালের ৪ঠা জানুয়ারি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা কম্যুনিটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন এর সকল স্তরের সদস্য, দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে প্রিয় লেখকের জন্মবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।
তাংঃ- ১২/২/২০২১