বাংলার আধুনিক চিত্রকলা ইতিহাসের অনন্য শিল্পী ছিলেন যামিনী রায়। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের মধ্যভাগে বাংলার আধুনিক চিত্রকলা ইতিহাসের একজন শিল্পী।
আঠারোশো সপ্তাশী সালের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ এগারোই এপ্রিল পশ্চিমবঙের বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড় গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর শৌখিন শিল্পি পিতা অবসর জীবন গ্রামে কাটান, যেখানে বেশ কয়েক ঘর কুমারের বাস ছিল। শিল্পিমনা পিতা এবং স্বীয় গ্রামের কুমোর পাড়ার প্রভাব যামিনী রায়ের শিল্পি জীবন অন্বেষায় পরোক্ষ ভূমিকা রাখে।
উনিশশো ছয় সাল থেকে উনিশশো চৌদ্দ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক রীতিতে শিক্ষা গ্রহণ করেন। আর্ট স্কুলে ইতালীয় শিল্পি গিলার্দি ও পরে অধ্যক্ষ পার্সি ব্রাউনের সংস্পর্শে এসে তিনি প্রাচ্য-প্রতীচ্যের উভয় শিল্পের কলা-কৌশলের সাথে পরিচিত হন।
জীবনের প্রারম্ভে তিনি পাশ্চাত্য রীতি গ্রহণ করেন এবং এতে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। এ সময় তিনি পেশাদার শিল্পি জীবনে প্রবেশ করেন ও পাশ্চাত্যের বিখ্যাত পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পি সেজান, ভ্যান গগ ও গগ্যাঁ-র অনুকরণে নিরীক্ষাধর্মী ছবি অংকন করেন।
কিন্তু এর পাশাপাশি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নব্য-বঙ্গীয় চিত্রকলার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও আগ্রহের কারণে তেল রঙে নব্য-বঙ্গীয় রীতির ব্যঞ্জনায় আবহমান বাংলার মানুষের জীবন ও জীবিকার দৃশ্য তাঁর চিত্রপটে তুলে ধরেন।
এসময় প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের উভয় ধারার চিত্রে তাঁর নিজস্ব শিল্প রীতিতে লোক শিল্পের সারল্য, বলিষ্ঠভাব, সমতলীয় রঙ, সুদৃঢ় রেখা ইত্যাদি ফুটে ওঠে।
শিল্পি যামিনী রায় শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক রীতির আড়ম্বরপ্রিয়তা পরিহার করে দেশজ সরল রীতিতে চিত্র নির্মাণে ব্রতী হন।
বাংলার লোকজ পুতুল, শিশুদের অাঁকা চিত্র ইত্যাদি তিনি তাঁর ছবির ‘ফর্ম’ হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি বিষয় হিসেবে বেছে নেন গ্রাম বাংলার সরল মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখর চিত্র, ধর্মাশ্রয়ী কাহিনী যেমন- রামায়ণ, শ্রীচৈতন্য, রাধা-কৃষ্ণ ও যীশু।
এছাড়া বেলিয়াতোড় গ্রামের আশেপাশের গ্রামগুলির সাঁওতালদের জীবনের চিত্ররূপ ‘সাঁওতাল জননী ও শিশু’,‘মাদলবাদনরত সাঁওতাল’, ‘নৃত্যরত সাঁওতাল’ ইত্যাদি। বর্ণাঢ্য রঙ ওছন্দোময় রেখার ঐকতানের মাধ্যমে তিনি তাঁর চিত্রে এক নিজস্ব ভাবের উন্মেষ ঘটান।
তাঁর রেখায় দেখা দেয় কুমোর পাড়ার পুতুল গড়ার সৌষ্ঠবের অনুপুঙ্খ রূপের প্রাচুর্য; আরেক পর্বে কালীঘাট চিত্রকলার সুডৌল রেখার আলিম্পন।
এ রীতিতে তিনি ত্রিমাত্রিকতা পরিহার করে সমতলীয় বর্ণিল চিত্রপটে অবলিলাক্রমে নির্মাণ করে যান কাহিনী ব্যতিরেকে ‘মা ও শিশু’, ‘রাঁধা-কৃষ্ণ’, ‘যীশু’ ইত্যাদি।
শিল্পি জীবনের সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে যামিনী রায় নিজস্ব উদ্ভাবিত শৈলী বা চিত্রভাষায় ছবি অঙ্কন করে যশস্বী হয়েছেন।
তাঁর এ শৈলীর নাম তিনি দিয়েছিলেন ফ্ল্যাট টেকনিক। সে সময় বেঙ্গল স্কুলের জয়জয়কার ছিল বলে কেউ তাঁর এই টেকনিক গ্রহণ করেননি।
উনিশশো আটত্রিশ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিটে যামিনী রায়ের ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয়। সে সময় পরিচয় নামক কলকাতার এক ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর শিল্পকৃতির আলোচনা হওয়ার ফলে তাঁর ছবি পরিচিতি লাভ করে।
এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে আগত মার্কিন সৈনিক ও অফিসারবৃন্দ যামিনী রায়ের নয়নাভিরাম চিত্র দেখে তা অধিক মূল্যে ক্রয় করার ফলে তাঁর ছবির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
গ্রাম-বাংলার পটুয়াদের শিল্পকর্মের মতো ধনী-নির্ধন সবার কাছে যাতে তাঁর চিত্র সহজলভ্য হয় সেজন্য শিল্পি যামিনী রায় অসংখ্য চিত্র নির্মাণ করেন।
তাঁর চিত্র স্বল্পমূল্য ও সহজলভ্য করার জন্য পটুয়াদের মতো তিনি তাঁর চিত্রে দেশজ উপাদান যেমন- ভূষোকালি, খড়িমাটি, বিভিন্ন লতাপাতার রস থেকে আহরিত রং ব্যবহার করতেন।
পটচিত্রের আদলে নির্মিত প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর যামিনী রায়ের চিত্র আজও শিল্পামোদী, এমনকি চিত্রবিমুখ সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
উনিশশো বাহাত্তর সালের চব্বিশে এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আজ তার জন্মবার্ষিকীতে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সকল সদস্য দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি অজস্র ভালোবাসা এবং বিনম্র শ্রদ্ধা।
তারিখঃ- ১১/৪/২০২১ ইং।