বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনায় আশির দশকে শক্তি সামন্ত নির্মাণ করেন ‘অন্যায় অবিচার’ ছবিটি। মিঠুন চক্রবর্তী, রোজিনা, উৎপল দত্ত অভিনীত ছবিটি বাংলাদেশে ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পায়।
তিনি শক্তি ফিল্মস এর প্রতিষ্ঠাতা। মুম্বাইতে অনেক বাঙালি অভিনয় শিল্পী সংগীতশিল্পী,কলাকুশলী পায়ের নিচে মাটি পান তাঁর মাধ্যমেই। শর্মিলা ঠাকুর এর মতো অভিনেত্রীও মুম্বাইতে শক্ত অবস্থান গড়েন তাঁর সহায়তায়। বাপ্পী লাহিড়িকে মুম্বাইতে প্রতিষ্ঠার পিছনেও রয়েছে তাঁর অনেক অবদান।
নতুন ইমেজ নতুন ধারা নতুন কাহিনি দিয়ে মুম্বাই সিনেজগতের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিলেন যে শক্তিশালী পরিচালক তাঁর নাম শক্তি সামন্ত। বলিউডে রাজত্ব করা বাঙালি পরিচালকদের অন্যতম ছিলেন তিনি।
তাঁর হাত ধরেই হিন্দি সিনে পাড়ায় পায়ের তলায় মাটি খেুঁজে পেয়েছেন শর্মীলা ঠাকুর শাম্মী কাপুর রাজেশ খান্নারা।
চায়না টাউন,হাওড়া ব্রিজ, কাশ্মির কি কলি, কাটি পাতাং,অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস,আরাধনা,অমানুষ,আনন্দ আশ্রম, অন্যায় অবিচার এর মতো একাধারে ব্যবসা সফল ও আলোচিত ছবির জনক শক্তি সামন্ত ছিলেন বলিউডের অন্যতম সেরা প্রতিভাবান পরিচালক ও প্রযোজক।
শক্তি সামন্তর জন্ম উনিশশো ছাব্বিশ সালের তেরোই জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। উনিশশো চুয়াল্লিশ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন।
শক্তি সামন্তর ইচ্ছা ছিল অভিনেতা হওয়ার। তাই তিনি মুম্বাই চলে যান। উনিশশো আটচল্লিশ সালে তিনি সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
রাজকাপুর অভিনীত সতীশ নিগম পরিচালিত সুনহেরে দিন ছবিতে তিনি প্রথম কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি গণেষ মুখার্জি ও ফণি মজুমদারের মতো নামজাদা পরিচালকের সহকারি হিসেবে কাজ করেন।
উনিশশো চুয়ান্ন সালে শক্তি সামন্ত পরিচালিত প্রথম ছবি ‘বহু’ মুক্তি পায়। ছবিটি ব্যবসা সফল হওয়ায় পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পথে দ্রুত এগিয়ে যান তিনি।
একে একে মুক্তি পায় তাঁর পরিচালিত ইন্সপেকটর শেরু ডিটেকটিভ এবং হিল স্টেশন। প্রতিটি ছবিই ব্যবসা সফল হয়।
এরপর উনিশশো সাতান্ন সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান শক্তি ফিল্মস। শক্তি ফিল্মস থেকে মুক্তি পাওয়া প্রথম সিনেমা হাওড়া ব্রিজ। অশোক কুমার ও মধুবালা ছিলেন এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে।
সিনেমার সংগীত পরিচালক ছিলেন ওপি নায়ার। আশা ভোঁশলের কণ্ঠে গানগুলো বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। ব্যবসায়িক দিক থেকে হাওড়া ব্রিজ রীতিমতো ইতিহাস সৃষ্টি করে। দারুণ বাণিজ্যিক সাফল্য রহস্য রোমাঞ্চ নতুন ধরণের গল্প অসাধারণ অভিনয় আর দুর্দান্ত পরিচালনা সব মিলিয়ে সিনেমাটি দর্শকদের মন জয় করে নেয় খুব সহজেই।
এছাড়া মধুবালার সৌন্দর্য দারুণ গ্ল্যামারাসভাবে ফুটে ওঠে পর্দায়। অন্যদিকে গীতা দত্তের প্লেব্যাকে মেরা নাম চিন চিন চু গানের সঙ্গে অসাধারণ নৃত্য ভঙ্গিমা প্রদর্শন করে আবেদনময়ীরূপে প্রতিষ্ঠা পান হেলেন।
সুনীল দত্ত-মধুবালা অভিনীত ইনসান জাগ উঠা সিনেমায় শক্তি সামন্ত সমাজ পরিবর্তনের বক্তব্য তুলে ধরেন। কিন্তু সমালোচকদের প্রশংসা পেলেও ছবিটি বাণিজ্যিক সাফল্য খুব একটা পায়নি। ফলে শক্তি সামন্ত আবার বাণিজ্যিক ধারার ছবি নির্মাণে মনোযোগী হন।
উনিশশো বাষট্টি সালে সুপার ডুপার হিট হয় চায়না টাউন। শাম্মি কাপুর অভিনীত ছবিটিকে বলা যায় হিন্দি ছবির এক ট্রেন্ডসেটার। নতুন ধারার এই ছবিতে খ্যাতির আলোয় চলে আসেন শাম্মীকাপুর।
উনিশশো চৌষট্টি সালে কাশ্মির কি কলি ছবির মাধ্যমে বলিউডকে আবারও এক নতুন তারকা উপহার দেন শক্তি সামন্ত। তিনি হলেন বাঙালি মেয়ে শর্মিলা ঠাকুর। এর আগে শর্মিলা ঠাকুর সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয় করে প্রশংসা ও সাফল্য পেয়েছেন । কিন্তু গ্ল্যামার বাণিজ্যিক সফলতা ও চোখ ধাঁধানো বিনোদনের জগতে তাকে নিয়ে আসেন শক্তি সামন্ত।
কাশ্মির কি কালি এর জলপ্রিয়তার ধারাবাহিকতায় শর্মিলা ঠাকুরকে নিয়ে তিনি কাজ করেন সাওয়ান কি ঘাটা অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস আরাধনা এর মতো সিনেমায়।
এরমধ্যে উনিশশো সাতষট্টি সালে মুক্তি পাওয়া অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস এ ছবিতে বিকিনি পরিহিতা শর্মিলা ঠাকুরের আবেদনময়ী রূপ প্রথমবারের মতো দেখে হিন্দি ছবির দর্শক।
বাণিজ্যিক সাফল্য পাওয়া এই সিনেমার মাধ্যমেই শাম্মি কাপুরও গড়ে তোলেন তাঁর আধুনিক ইমেজ।
উনিশশো উনসত্তর সালে মুক্তি পায় আরাধনা।
রাজেশ খান্না শর্মিলা ঠাকুর অভিনীত অসামান্য প্রেমের ছবি।আরাধনা কে বলা যায় রোমান্টিক ছবির জগতে এক মাইল ফলক। রাজেশ খান্নাকে রোমান্টিক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিতই করেন শক্তি সামন্ত। রাজেশ-শর্মিলা জনপ্রিয় জুটির যাত্রা শুরু হয় আরাধনা র মাধ্যমে।
এ ছবির গানগুলো আজও চিরসবুজ প্রেমের গানের তালিকায় রয়েছে।
মেরে সপনে কি রাণী কাব আয়েগি তু গানটির সঙ্গে ট্রেনের কামরায় শর্মিলা ঠাকুর ও জিপ গাড়িতে রাজেশ খান্নার দৃশ্যায়ন ছিল দারুণ সুন্দর।
পরিচালকের মুন্সিআনায় আরাধনা হয়ে ওঠে সর্বকালের অন্যতম সেরা প্রেমের ছবি| বাংলা ও হিন্দি দুই ভাষায় নির্মিত হয় সিনেমাটি।
রাজেশ খান্না-আশা পারেখ অভিনীত কাটি পাতাং ও শক্তি সামন্ত পরিচালিত একটি অসাধারণ প্রেমের ছবি। এ ছবির সংগীতও ছিল দুর্দান্ত। সুপার হিট হয় এ ছবিটিও।
বিনোদ মেহরা মৌসুমী চ্যাটার্জি অভিনীত অনুরাগ সিনেমাটি আরাধনা এর মতোই দ্বিভাষিক। এটিও বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছিল।
সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে ফিল্ম ফেয়ার আসরে পুরস্কৃত হয় ছবিটি। এটি পরে মালায়াম ও তেলেগু ভাষাতে রিমেইক হয়। তেলেগু ছবিতে অভিনয় করেন শ্রীদেবী।
উনিশশো সাতান্ন সালে উত্তম কুমারকে নতুন ইমেজে উপস্থাপন করেন শক্তি সামন্ত অমানুষ ছবির মাধ্যমে। সুন্দরবনের পটভূমিকায় ছবিটিতে উত্তম কুমার শর্মিলা ঠাকুর ও উৎপল দত্ত অসাধারণ অভিনয় করেন।
মারদাঙ্গা ছবিতে সেই প্রথম অভিনয় করেন উত্তম কুমার। নতুন ওই ভূমিকায় দিব্যি মানিয়েও যায় তাকে। এ ছবিটি দ্বিভাষিক ছিল। অমানুষ দুর্দান্ত ব্যবসা করে।
এ ছবির গান ‘কি আশায় বাঁধি খেলাঘর’ বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।
উনিশশো সাতাত্তর সালে তাঁর পরিচালিত উত্তমকুমার, শর্মিলা ঠাকুর ও উৎপল দত্ত অভিনীত আনন্দ আশ্রম ও দ্বিভাষিক ছবি। এ ছবিটিও সুপার হিট হয়।
এ ছবির আশা ছিল ভালোবাসা ছিল, পৃথিবী বদলে গেছে, আমার স্বপ্ন তুমি গানগুলো এখনও চিরসবুজ প্রেমের গান হিসেবে স্বীকৃত।
শক্তি সামন্ত পরিচালিত অমিতাভ বচ্চন অভিনীত দ্যা গ্রেট গ্যাম্বলার দারুণ সাফল্য পায়। অমিতাভ বচ্চনের অভিনয়ে আরেকটি দ্বিভাষিক ছবি নির্মাণ করেন শক্তি সামন্ত। বারসাত কি এক রাত বাংলায় অনুসন্ধান ছবিতে অভিনয় করেন অমিতাভ বচ্চন রাখি উৎপল দত্ত। ছবিটি বাণিজ্যিক সাফল্য পায়।
উনিশশো পঁচাশি সালে মিঠুন চক্রবর্তী, রোজিনা, উৎপল দত্ত, অমল বোস অভিনীত অন্যায় অবিচার ও দ্বিভাষিক ছবি। এটি বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনার ছবি।বাংলাদেশে ও কলকাতায় দুর্দান্ত ব্যবসা করে ছবিটি।
শক্তি সামন্ত ছয়টি দ্বিভাষিক ছবি নির্মাণ করেন।
বাংলায় তিনি নির্মাণ করেন দেবদাস, অন্ধবিচার সহ কয়েকটি ছবি।
পরিচালক-প্রযোজক দুই ভূমিকাতেই অপরিসীম সাফল্য পান শক্তি সামন্ত। তাঁর ছবি বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি এমনটি খুব কমই হয়েছে।
সেরা চলচ্চিত্রের জন্য শক্তি সামন্ত ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার জয় করেছেন আরাধনা, অনুরাগ, অমানুষ ছবির সুবাদে।
বার্লিন তাশখন্দ মস্কো কায়রোন বৈরুতসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসা কুড়িয়েছে তাঁর ছবি।
তিনি ছিলেন পুরোপুরি বাণিজ্যিক ধারার পরিচালক। দর্শককে কিভাবে বিনোদন দিতে হয় কিভাবে আবেগে আপ্লুত করতে হয় সেই শিল্প ছিল তাঁর সম্পূর্ণ আয়ত্তে।
দুই হাজার নয় সালের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ নয় এপ্রিল এই গুণী পরিচালক মৃত্যুবরণ করেন। তবে প্রতিভাবান এই বাঙালি চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব বেঁচে আছেন তাঁর পরিচালিত দর্শকনন্দিত অসংখ্য চলচ্চিত্রের মাধ্যমে।
লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সকল সদস্য দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে গুণী এই পরিচালকের মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।
তারিখ:- ০৯/০৪/২০২১ ইংরেজি