জ্ঞানতাপস হিসেবে পরিচিত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও ভাষাতত্ত্ববিদ। জীবনভর ভাষা ও সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘প্রাইড অফ পারফরম্যান্স’, ফরাসি সরকার কর্তৃক ‘নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্ট লেটার্স’ উপাধিতে ভূষিত হন।
আঠারোশো পঁচাশি সালের দশ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে তাঁর জন্ম।
ছোটবেলা থেকেই মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভাষা ও জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হন। তিনি ছোটবেলায় ঘরোয়া পরিবেশে উর্দু, ফারসি ও আরবি শেখেন এবং স্কুলে সংস্কৃত পড়েন।
তিনি উনিশশো বারো সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ পাস করেন। দুবছর পর তিনি বি.এল ডিগ্রিও অর্জন করেন।
উনিশশো একুশ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে তিনি যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা তাঁর জীবনের সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এখানে শিক্ষাদান কালে তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে মৌলিক গবেষণা করেন এবং উনিশশো পঁচিশ সালে প্রমাণ করেন যে, গৌড়ী বা মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ উনিশশো ছাব্বিশ সালে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ইউরোপ যান। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বৈদিক ভাষা, বৌদ্ধ সংস্কৃত, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, তিববতি ও প্রাচীন পারসিক ভাষা এবং জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন খোতনি, প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা শেখেন।
উনিশশো আঠাশ সালে তিনি বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদাবলি বিষয়ে গবেষণা করে প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
এ বছরই ধ্বনিতত্ত্বে মৌলিক গবেষণার জন্য তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমাও লাভ করেন এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন।
অতঃপর সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগ ভেঙ্গে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ হলে উনিশশো সাঁইত্রিশ সালে তিনি বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ হন এবং উনিশশো চুয়াল্লিশ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। উনিশশো আটচল্লিশ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগীয় প্রধান ও কলা অনুষদের ডীন হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে (ফরাসি ভাষার) খন্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। উনিশশো পঞ্চান্ন থেকে আটান্ন সাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। উনিশশো সাতষট্টি সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস নিযু্ক্ত হন।
অধ্যাপনার বাইরে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ করাচির উর্দু উন্নয়ন সংস্থার ‘উর্দু অভিধান প্রকল্প, ঢাকার বাংলা একাডেমীর ‘পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্প’ এবং ‘ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্প’-এ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক, ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রভোস্ট, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সদস্য, ইসলামিক একাডেমীর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, বাংলা একাডেমীর বাংলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার ও দাউদ সাহিত্য পুরস্কার কমিটির স্থায়ী চেয়ারম্যান ছিলেন।
ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে শহীদুল্লাহ্ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনিই প্রথম উর্দুর পরিবর্তে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিক দাবি জানান। তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক ছিলেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভা ও সম্মেলনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলন, ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ সম্মেলন, কলকাতায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম যুবক সম্মেলন, হায়দ্রাবাদে নিখিল ভারত প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলন এবং পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন।
মাদ্রাজে ‘ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার অন ট্রাডিশনাল কালচার ইন সাউথ-ইস্ট এশিয়া’ অনুষ্ঠানে তিনি ইউনেস্কোর প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তার চেয়ারম্যান মনোনীত হন।
ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে শহীদুল্লাহ্র বহু মননশীল ও জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ নানা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেন।
আল এসলাম পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে তিনি যোগ্যতার পরিচয় দেন। তাঁরই সম্পাদনা ও প্রকাশনায় মুসলিম বাংলার প্রথম শিশুপত্রিকা আঙুর আত্মপ্রকাশ করে।
এছাড়াও তিনি ইংরেজি মাসিক পত্রিকা দি পীস, বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা বঙ্গভূমি এবং পাক্ষিক তকবীর সম্পাদনা করেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস রচনাসহ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বহু জটিল সমস্যার সমাধান করেন। বাংলা লোকসাহিত্যের প্রতিও তিনি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। গবেষণাগ্রন্থের পাশাপাশি তিনি সাহিত্য এবং শিশুসাহিত্যের অনেক মৌলিক গ্রন্থও রচনা করেন।
তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ অনুবাদ ও সম্পাদনাও করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো সিন্দবাদ সওদাগরের গল্প, ভাষা ও সাহিত্য, বাঙ্গালা ব্যাকরণ, দীওয়ান-ই-হাফিজ, শিকওয়াহ ও জওয়াব-ই-শিকওয়াহ, রুবাইয়াত-ই-উমর খয়্যাম, Essays on Islam, আমাদের সমস্যা, পদ্মাবতী, বাংলা সাহিত্যের কথা, বিদ্যাপতি শতক, বাংলা আদব কী তারিখ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত, কুরআন শরীফ, অমরকাব্য, সেকালের রূপকথা ইত্যাদি।
তাঁর সম্পাদিত আঞ্চলিক ভাষার অভিধান এক বিশেষ কীর্তি। মুহম্মদ আবদুল হাই -এর সঙ্গে তাঁর যুগ্ম-সম্পাদনায় রচিত Traditional Culture in East Pakistan একখানা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
তাঁর Buddhist Mystic Songs গ্রন্থটি চর্যাপদের অনুবাদ ও সম্পাদনা কর্ম। তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে চর্যাপদ সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় রচিত এর ধর্মতত্ত্ব নিয়েও তিনি আলোচনা করেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন বহুভাষাবিদ এবং ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন। তিনি আঠারোটি ভাষা জানতেন; ফলে বিভিন্ন ভাষায় সংরক্ষিত জ্ঞানভান্ডারে তিনি সহজেই প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান; তাঁর ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে ধর্ম সম্পর্কে তাঁর আন্তরিক বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি ইসলামের প্রকৃত তাৎপর্য তুলে ধরার জন্য গ্রামে-গঞ্জে ওয়াজ-মাহফিলে বক্তৃতা করতেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ উনিশশো উনসত্তর সালের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ তেরো জুলাই ঢাকায় পরলোক গমন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ্ হল চত্বরে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সকল সদস্য, দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।
তাংঃ- ১৩/৭/২০২১ ইং।