আশির দশকের রূপালি পর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা জাফর ইকবাল। তবে শুধু তাকে অভিনেতা হিসেবে পরিচয় দিলে ভুল হবে। তিনি ছিলেন গায়ক, এছাড়াও তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন উনিশশো একাত্তর সালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন মহান মুক্তিযুদ্ধে।
উনিশশো পঞ্চাশ সালের পঁচিশে সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশানে জন্ম হয় জাফর ইকবালের। বাড়িতে গানবাজনার রেওয়াজ ছিল। তাঁর বোন শাহানাজ রহমতুল্লাহ একজন সুপরিচিত কণ্ঠশিল্পী। বড় ভাই আনোয়ার পারভেজও নামকরা শিল্পী।
জাফর ইকবাল প্রথমে গায়ক হিসেবেই পরিচিতি পান। উনিশশো ছেষট্টি সালে তিনি নিজের একটি ব্যান্ড গড়ে তোলেন। ‘পিচঢালা পথ’ সিনেমায় তিনি প্রথম গান করেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি কবরীর বিপরীতে ‘আপন পর’ ছবিতে অভিনয় করেন। সেটিই তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র।
উনিশশো একাত্তর সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশনেন জাফর ইকবাল। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। ‘সূর্যসংগ্রাম’ ও এর সিকুয়াল ‘সূর্যস্বাধীন’ চলচ্চিত্রে ববিতার বিপরীতে অভিনয় করেন।
উনিশশো পঁচাত্তর সালে ‘মাস্তান’ চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় তাঁকে সে প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের রাগী, রোমান্টিক, জীবন-যন্ত্রণায় পীড়িত কিংবা হতাশা থেকে বিপথগামী তরুণের চরিত্রে তিনি ছিলেন পরিচালকদের অন্যতম পছন্দ।
সামাজিক প্রেমকাহিনী ‘মাস্তানে’র নায়ক জাফর ইকবাল রোমান্টিক নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পান। ‘নয়নের আলো’ চলচ্চিত্রে এক গ্রামীন তরুণের চরিত্রেও দর্শক তাকে গ্রহণ করে।
জাফর ইকবাল প্রায় একশো পঞ্চাশটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। যার বেশিরভাগই ছিল ব্যবসা সফল। উনিশশো উননব্বই সালে জাফর ইকবাল অভিনীত ত্রিভূজ প্রেমের ছবি ‘অবুঝ হৃদয়’ দারুণ ব্যবসা সফল হয়। এ ছবিতে চম্পা ও ববিতার বিপরীতে তাঁর অভিনয় দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। ববিতার সঙ্গে তাঁর জুটি ছিল দর্শক নন্দিত। এই জুটির বাস্তব জীবনে প্রেম চলছে বলেও গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল।
তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ায় হতাশ হয়েই জাফর ইকবাল অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে জোর গুঞ্জন উঠেছিল। ববিতার বিপরীতে ত্রিশটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
জাফর ইকবাল অভিনীত ভাই বন্ধু, চোরের বউ, অবদান, সাধারণ মেয়ে, একই অঙ্গে এত রূপ, ফকির মজনুশাহ, দিনের পর দিন, বেদ্বীন, অংশীদার, মেঘবিজলী বাদল, সাত রাজার ধন, আশীর্বাদ, অপমান, এক মুঠো ভাত, নয়নের আলো, গৃহলক্ষ্মী, ওগো বিদেশিনী, প্রেমিক, নবাব, প্রতিরোধ, ফুলের মালা,সিআইডি, মর্যাদা, সন্ধি ইত্যাদি চলচ্চিত্র সুপারহিট হয়।
গায়ক হিসেবেও তিনি ছিলেন জনপ্রিয়। ‘বদনাম’ ছবিতে তাঁর কণ্ঠে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’ আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে ঠাঁই করে আছে।
চলচ্চিত্রের বাইরে তাঁর গাওয়া গানগুলোর মধ্যে ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’, ‘যে ভাবে বাঁচি, বেঁচে তো আছি’, ‘এক হৃদয়হীনার কাছে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আশির দশকের শুরুতে তার ক্যারিয়ার বিভিন্ন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি ছিলেন বেশ খামখেয়ালী, আবেগপ্রবণ এবং দারুণ অভিমানী। অনিয়মিত জীবনযাপন ও অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে তার হৃদযন্ত্র ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জাফর ইকবালের ক্যারিয়ার যখন মধ্যগগনে তখন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি। উনিশশো বিরানব্বই সালের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ আট জানুয়ারি মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন জাফর ইকবাল।
আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সকল সদস্য, দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।
তারিখঃ- ৮/১/২০২১ ইং।