বিমল রায় ছিলেম একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি চিত্র পরিচালক এবং প্রযোজক। তার অনন্য সৃষ্টি ‘দো বিঘা জমীন’ কান চলচ্চিত্র উৎসব, কার্লোভিভেরি এবং ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পুরস্কার লাভ করেছিল।
তার পরিচালিত সাড়া জাগানো চলচ্চিত্রের ভিতরে উদয়ের পথে, অঞ্জনগড়, মা, দো বিঘা জমীন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা জেলায় উনিশশো নয় সালের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ বারোই জুলাই তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
উনিশশো চুয়াল্লিশ সালে নিউ থিয়েটার্সের বাংলা ছবি ‘উদয়ের পথে’ মুক্তি পায় বিমল রায়ের পরিচালনায়। শ্রেণী সংগ্রামভিত্তিক বলিষ্ঠ ছবি উদয়ের পথে ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিল ওই সময়ের চলচ্চিত্র সমালোচকদের কাছ থেকে। পরের বছর ছবিটির হিন্দি ‘হামরাহী’ নির্মাণ করেন তিনি।
চল্লিশের দশকের শেষে দেশভাগের পর নিউ থিয়েটার্সের প্রতিপত্তি কমতে থাকে। এক সময় নিউ থিয়েটার্স বন্ধ হয়ে গেলে অশোক কুমারের উদ্যোগে মুম্বাইয়ে হিমাংশু রাই-দেবিকা রানী প্রতিষ্ঠিত ‘বম্বে টকিজ’-এ যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পান বিমল রায়। ওই বম্বে টকিজ থেকে ছবি করেন ‘মা’। এটি মুক্তি পায় উনিশশো বায়ান্ন সালে।
এছাড়া পরের বছর অর্থাৎ উনিশশো তিপান্ন সালে শরৎচন্দ্রের ‘পরিণীতা’ উপন্যাস অবলম্বনে দুই প্রতিবেশীর মিষ্টি প্রেমের এ ছবির পরিচালক বিমল রায়। এরপর নিজেই একটি ছবির কোম্পানি খোলেন। বিমল রায় প্রডাকশনের প্রথম ছবি ছিল ‘দো বিঘা জমিন’।
বিমল রায় এক সঙ্গে দুটি ছবির কাজ শুরু করেন- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পরিণীতা’ ও সলিল চৌধুরীর লেখা গল্প ‘রিকশাওয়ালা’ অবলম্বনে ‘দো বিঘা জমিন’। এই দো বিঘা জমিন ভারতীয় সিনেমায় এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল।
লীলা চিটনিস, ভারত ভূষণ ও শ্যামা অভিনীত এ ছবির গল্প ছিল একেবারেই গতে বাঁধা মেলোড্রামা। কিন্তু ছবিটি উতরে গিয়েছিল বিমল রায়ের হাতের ছোঁয়ায়।
উনিশশো চুয়ান্ন সালে Cannes Film Festival এ পুরস্কৃত হয় দো বিঘা জমিন। আন্তর্জাতিক খ্যাতি আসে চীন, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, ইটালি থেকেও।
এরপর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে বিমল রায় আরও দুটি ছবি করেন হিন্দিতে বিরাজ বউ ও দেবদাস।
বিমল রায়ের মধ্যে সব সময়ই ছিল একটা সমাজ সচেতনতা। তিনি সমাজতান্ত্রিক ভাবনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। উনিশশো আটান্ন সালে তৈরি করলেন দুটি ছবি মধুমতী ও ইয়েহুদি। বাণিজ্যিকভাবে দুটি ছবিই সুপারহিট। নিঃসন্দেহে মধুমতী সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবি।
আজ এতো বছর পরও মধুমতী একই রকম চর্চিত। এটি মোট নয়টি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল। তখন ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড দেয়া হতো ছবির গুণগত মান বিচার করে।
মস্কোয় উনিশশো উনষাট সালে প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের বিমল রায় অন্যতম জুরি ছিলেন। তিনি কিছুকাল ফিল্ম গিল্ড অফ ইন্ডিয়ার সহকারী সভাপতি এবং ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সভাপতি হয়েছিলেন।
বাণিজ্যিক সাফল্যের চূড়া থেকে নেমে এসে উনিশশো উনষাট সালে বিমল রায় আরেকবার তার নব্য বাস্তববাদী সত্তার পরিচয় রাখলেন ‘সুজাতা’য়।
এই সিনেমার মাধ্যমে প্রকাশ পায় আমাদের সমাজে প্রচলিত ‘জাতের নামে বজ্জাতি’র কুরূপ উন্মোচন করা এক সহানুভূতিশীল প্রতিবেদন। সংবেদনশীল মন নিয়ে বিমল রায়ের সুসংযত পরিচালনা ও নায়িকা নূতনের অপূর্ব অভিনয় সুজাতা ছবির মস্ত সম্পদ।
বিমল রায় পরিচালিত শেষ কাহিনীচিত্র বন্দিনী। নূতনের অভিনয় প্রতিভা তিনি আবার কাজে লাগালেন জরাসন্ধ-এর লৌহ কপাট থেকে নেয়া গল্প ‘বন্দিনী’ ছবিতে। তার প্রযোজনায় এবং হেমেন গুপ্তের পরিচালনায় কাবুলিওয়ালা ছবিটি জনপ্রিয় হয়েছিল।
বেশ কিছুদিন ফুসফুসের ক্যানসারে ভোগার পর উনিশশো ছেষট্টি সালের আটই জানুয়ারি মাত্র ছাপান্ন বছর বয়সে বিমল রায়ের মৃত্যু হয়।
আজ তার জন্মবার্ষিকীতে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।
তাংঃ- ১২/৭/২০২১ ইং