বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক আবুল ফজলের জন্মবার্ষিকী আজ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ উপাচার্য ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল।

তিনি ছিলেন মূলত একজন চিন্তাশীল ও সমাজমনস্ক প্রবন্ধকার। তার প্রবন্ধে সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে গভীর ও স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।

চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার অন্তর্গত কেঁওচিয়া গ্রামে উনিশশো তিন সালের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ পহেলা জুলাই তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি উনিশশো আটাশ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন।পরে উনিশশো চল্লিশ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

উনিশশো তেতাল্লিশ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং সেখান থেকেই উনিশশো ছাপান্ন সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

উনিশশো তিয়াত্তর সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে যোগদান করেন। উনিশশো পঁচাত্তর সালের নভেম্বর থেকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন এবং পরবর্তীতে উনিশশো সাতাত্তর সালের তেইশে জুন ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন।

আবুল ফজল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। উনিশশো ত্রিশ সালে তিনি এর সম্পাদক হন।

মুসলিম সাহিত্য সমাজের উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক কুসংস্কার ও অন্ধ শাস্ত্রানুগত্য থেকে মানুষকে মুক্ত করা। এ উদ্দেশে তাঁরা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁদের সে আন্দোলনের বার্তা সর্বত্র পৌঁছে দেওয়ার জন্য উনিশশো ছাব্বিশ সালে তাঁরা প্রকাশ করেন সমাজের মুখপত্র শিখা।

মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও শিখার সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁরা ‘শিখাগোষ্ঠী’ নামে পরিচিত ছিলেন। এ গোষ্ঠী তখন ঢাকায় বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন শুরু করে।

তাঁদের আন্দোলনের মূলকথা ছিল ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’।

শিখাগোষ্ঠীর এ আন্দোলনের মাধ্যমে আবুল ফজল যে মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী হয়েছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁর রচনায় তার প্রতিফলন ঘটেছে।

তিনি সমাজ ও যুগসচেতন লেখক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। কথাশিল্পী হিসেবেও তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। স্বদেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা, সত্যনিষ্ঠা, মানবতা ও কল্যাণবোধ ছিল তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রতিপাদ্য বিষয়।

একজন সমাজসচেতন বুদ্ধিজীবী হিসেবে আবুল ফজল ছিলেন নিঃশঙ্কচিত্ত। জাতির বিভিন্ন সংকটকালে তাঁর নির্ভীক ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাঙালি সংস্কৃতি এবং বাঙালি জাতির প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ ও মমত্ববোধ।

উনিশশো সাতষট্টি সালে পাকিস্তান সরকার যখন রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তানের আদর্শবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে রেডিও-টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তিনি এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান।

আবুল ফজল উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, আত্মকথা, ধর্ম, ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদি বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেন।

সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: চৌচির, প্রদীপ ও পতঙ্গ, মাটির পৃথিবী, বিচিত্র কথা, রাঙ্গা প্রভাত, রেখাচিত্র, দুর্দিনের দিনলিপি প্রভৃতি।

বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার, প্রেসিডেন্টের রাষ্ট্রীয় সাহিত্য পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার, এবং আবদুল হাই সাহিত্য পদকে ভূষিত হন।

উনিশশো চুয়াত্তর সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে।

গুণী এই মানুষটি উনিশশো তিরাশি সালের চৌঠা মে চট্টগ্রামে মৃত্যুবরণ করেন।

লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সকল সদস্য দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে তার জন্মবার্ষিকীতে জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।

তাংঃ- ১/৭/২০২১ ইং।

Facebook Comments