প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বনাম প্রকৃতির শিক্ষা: লোকজ সংস্কৃতি কোন পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করে?

আমি এই “লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনে” নিজেকে বিলিয়ে দিতে এসেছি নিজের ভেতরকার এক ভয়াবহ শূন্যতা থেকে সেটা হয়ত এখন থেকে এখানকার প্রায় সকল লেখায় ই প্রকাশ পাবে।

এই “লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন” যেহেতু আমার পরিবার তাই এখানে আমার মনের আজন্ম জমানো কথাগুলো একে একে প্রকাশ করতেই পারি। নিজের মনে সারাদিন ধরে বুনতে থাকা চিন্তার জালগুলো যখন এখানে প্রকাশ করতে থাকবো, লোকজ সংস্কৃতি সম্পর্কে হয়ত নিজের অজান্তেই ভাবনার বুননগুলো আমার মজবুত হয়ে উঠবে।

আচ্ছা আর বেশি অপ্রাসঙ্গিকতায় না যাই, আমি আজকে কি বলার ধান্দায় প্যাঁচাল পারতেছি সেইটা বলি।

“লোকজ সংস্কৃতি” যে এক অঞ্চল বা দেশের নিজস্বতা ধারণ করে সেটা তো আমরা সবাই কম বেশি বুঝি নাকি? যদি এখানে একদম এই প্রজন্মের কেউ থেকে থাকেন যাদের কখনো বাসার সামনে কোন খেলার মাঠ দেখার সুযোগ হয় নাই, জন্মের কিছুদিন পরেই যাদের ভুলিয়ে রাখার জন্য সামনে হাজির করা হয়েছিলো কাঁচের বন্দি এক কৃত্রিম জগত তাদের জন্য আফসোস!

তো যা বলছিলাম। “লোকজ সংস্কৃতি” এমন একটি ধারা যা কোন অঞ্চলের নিজস্বতা, তাদের প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বা বিনোদনের উদ্দেশ্যে করা নানা প্রকার আয়োজন ও প্রথাকে নির্দেশ করে। এই লোকজ সংস্কৃতির মাধ্যমে জন্ম থেকেই একটি শিশু তার মা বাবার সাথে প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠে আর সেই সাথে প্রকৃতির সাথে একাত্নতা প্রকাশ করে প্রকৃতির ধুলো-কাদায় মিশে গিয়ে সত্যিকারের শিক্ষা অর্জন করে ও বাস্তব জীবনে অহরহ তা অবচেতন মনেই প্রয়োগ করতে শিখে।

এক্ষেত্রে কখনো মা-বাবার এত বয়সের অভিজ্ঞতা বা বংশপরম্পরায় চলে আসা বিভিন্ন বিশ্বাস বা প্রথা সংযুক্ত হয় যা তাদের মূল্যবোধটাকে করে তোলে মজবুত।

তবে পশ্চিমা বিশ্বের আগ্রাসনে বা তাদের শক্তি প্রদর্শনের খাতিরে তাদের বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি ও শিক্ষাকেই উন্নত ধারার বলে প্রচার করে সমস্ত বিশ্বে একধারার যে শিক্ষা ও সংস্কৃতি ব্যবস্থার প্রচলন; আর সেটা যে তাদের ওই উপনিবেশিক বা স্থানীয় আগ্রাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্যই, তা যে কোন গবেষক ও উন্নত চিন্তার মানুষ মাত্রই অনুভব করে আছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন ডকুমেন্টারিও তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বর্তমানে লোক সংস্কৃতির বিলুপ্তি যে কোন এক স্থানীয় নিজস্বতাকে বিলুপ্ত করে এক প্রকার শোষণমূলক ব্যবস্থা তৈরি করে কোন স্থানীয় জনসাধারণকে ওই শোষণ ব্যবস্থার কেরানী হিসাবে তৈরি করছে তাতে আর কোন সন্দেহ নেই।

আমাদের উপমহাদেশের দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসনের আগ্রাসনের পর নানা আন্দোলনের মাধ্যমে তারা বিতাড়িত হলেও ব্রিটিশদের প্রচলিত বাহ্যিক কেতাদুরস্ত অবস্থা আর কেরানী তৈরী করার জন্য যে সাজানো শিক্ষাব্যবস্থা আর বর্তমান পরিস্থিতিতে সকলের সরকারি কেরানি(?) হবার যে মানসিকতা তা থেকে আমাদের সমাজ এখনো মুক্ত হতে পারেনি।

তবুও আমরা তথাকথিত উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে বিশ্বের পশ্চিমায়ন ব্যবস্থাকে এতটাই অপরিহার্য মনে করছি যে নিজের শেকড়, নিজের ঐতিহ্যকে পশ্চিমাদের এক সময়কার মগজ ধোলাইয়ের হাতিয়ার হিসাবে মনে না রেখে তাকে বরং এই প্রতিযোগিতার বিশ্বের ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্ধ মায়ায় বরণ করে নিচ্ছি।

যেন জীবনে প্রতিযোগিতাই সব, আমাদের শুধু অর্থের পিছে ছুটে জীবন জীবিকায় একটা আইডেন্টিটি বানাতে হবে যেখানে পদবী, টাকা-পয়সা, বিলাসিতা আর সমাজে উচ্চ ক্লাসে থাকার মায়াবী বাসনা কাজ করে। এক্ষেত্রে কোন প্রায়োগিক শিক্ষা বা সাধারণ বিবেকের ছিঁটে ফোঁটাও আজকাল ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে যাচ্ছে।

এই যে পশ্চিমা ধারার এই একমুখী শিক্ষা তাতে যেকোন মানুষের শেকড়কে ধবংস করে খুব সহজেই তাকে যান্ত্রিক ছাঁচে ফেলে বর্তমান প্রজন্মকে বইয়ের পাতায় আর যান্ত্রিক কাঁচের দেওয়ালে আবদ্ধ করে ফেলা যাচ্ছে যেখানে প্রকৃতি হতে পাওয়া শিক্ষা যে জীবনের যেকোন দুর্যোগে বা সুখে প্রায়োগিকভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে তা তাদের বোধেই নেই।

একদিকে বর্তমান প্রযুক্তি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আবিষ্কার করে চেষ্টা করে যাচ্ছে তাকে বোধ বুদ্ধি আবেগ দেওয়ার আর সেই আবেগকে ঢেলে দিতে গিয়ে আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম হয়ে পড়ছে আবেগহীন। এমন চলতে থাকলে হয়ত এমন দিন আসবে যখন আবেগহীন মানুষকে অনুকরণ করে পূর্ণতা পাবে কৃত্রিম প্রযুক্তি আর প্রকৃতির সৃষ্টি মানুষের হাতের কব্জায় বলে বোধ বুদ্ধি হারানো মানুষগুলো হারিয়ে ফেলবে তাদের শ্রেষ্টত্বটুকু!

আমাদের দেশের লোকজ সংস্কৃতিকে বর্তমান পশ্চিমা সংস্কৃতির চাপিয়ে দেওয়া আগ্রাসন কতটুকু নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে তা হয়ত গবেষণা হয়নি। তবে আজকালকার মাম্মি ড্যাডির সন্তানরা হয় এসব বিষয়ের আবেগ অনুভূতি বুঝতে অপারগ কিংবা নিজের শেকড়কে “ক্ষ্যাত” “আনকালচারড” বলে নিজের তথাকথিত অনুন্নত ঘুণে ধরা মগজটার প্রতিনিধিত্ব করে।

আর আমরা যারা কিছুটা প্রকৃতির সান্নিধ্যে ছিলাম তারা বুঝি গ্রাম্য সেই কাদা মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া সহজ সরল শিশুটার কত উদ্ভাবনী শক্তি! নিজের আর্থিক দৈন্যতা সত্বেও তার মনের ভেতরটা কত উদার। কিভাবে সে নিছক এঁটেল মাটি দিয়েই নিমেষে তৈরী করে ফেলে তার খেলনা, খেজুরের কাঁটা বুনে তৈরি করে ফেলে খেলনা ঘড়ি, চশমাসহ আরো কত কি!

আর আজকের শহরের বাচ্চাটাকে মা বাবা আলাদা করে স্পেশাল আর্ট এন্ড ক্রাফট ক্লাসে ভর্তি করিয়ে কিছু মুখস্থ জিনিস বানানো শেখায়।

সে যাক গে, লোকজ সংস্কৃতির অবহেলায় আমাদের মনুষ্যত্বের জায়গাটাতেই ঘুণে ধরে যাচ্ছে আর আমরা হয়ে যাচ্ছি এক শ্রেণি শোষকের টাকা বানানোর যন্ত্র।

প্রকৃতির শিক্ষাকে অবজ্ঞা করে ভুলভাবে প্রচার করা তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেলেই আর কোন কাজে লাগবে না কিংবা কোন নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য পূরণের পর আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে তা হয়ত ধন সম্পদের মোহে পড়া মানসিক সুখ শান্তি বিসর্জন দেওয়া প্রজন্মটি বুঝতে বুঝতে কয়েক যুগ পার হয়ে যাবে!

যখন বর্তমান যুগের বিষন্নতা, অস্থিরতা আর অরাজকতার কোন কূল কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না।

এই দূর্যোগ মহামারীর সময়েও যেখানে মানবিকতার খুবই প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে ভবিষ্যতের এক সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য। সেই ক্ষেত্রে আমাদের শেকড়ের সন্ধানে ফিরে যাবার প্রস্তুতি গ্রহণ করার হয়ত এখনই সর্বশ্রেষ্ঠ সময়।

পশ্চিম বিশ্বের সংস্কৃতি হয়ত আমাদের এই ভয়ংকর খারাপ পরিস্থিতিতে আমাদের সত্যিকারের মনন আর মাটি ও মানুষের সেই আদিম প্রক্রিয়ায় ফিরে যাওয়ার নিঃস্ব অবস্থাতে আমাদের অস্তিত্বকে বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে না। এরজন্য প্রয়োজন আমাদের গ্রাম বাংলার আবহমানকালের হারানো পুরোনো মূল্যবোধ, সেই সরল সাধারণ অথচ প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নিজেদের সকল চাহিদা পূরণের সেই অসাধারণ স্বনির্ভরশীলতা যা আমাদেরকে অন্যের মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে বিরত রাখে।

আমি তাই চাই বর্তমান জ্ঞান বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির যুগেও আমাদের সেই শেকড়ের কাছে গিয়ে তাদের সেই সময়ের স্বনির্ভরতা আর স্বকীয়তা টিকে থাকুক “লোকজ সংস্কৃতির” ইতিবাচক চর্চাগুলোর মাধ্যমেই।

আর “লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন” লোকজ সংস্কৃতির এই মাটি ও মানুষের প্রকৃতি প্রদত্ত শিক্ষায় বিশ্বাসী।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মোহে পড়ে আমরা যেন প্রাকৃতিক শিক্ষাকে কখনো ভুলে না যাই। প্রকৃতির মাঝে থেকেই মানুষ আজকের এই কৃত্রিম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবয়ব গড়ে তুলেছে। কৃত্রিম কোন আদল যে প্রকৃতির কাছ থেকেই নকল করে শেখা তা যেন আমরা কখনো বিস্মৃত না হই। বরং প্রকৃতির থেকে ট্রায়াল এন্ড এরর অর্থাৎ ভুল করতে করতে শিক্ষাকে আমরা যেন মূল্যায়ন করতে শিখি।

লোকজ সংস্কৃতি অমর হোক।

লেখক: তাসনিম বিনতে সাইফ
সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম জেলা
লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন।

Facebook Comments