“আলকাপ” দলের গুরু এবং বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জন্মবার্ষিকী আজ

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বাংলা সাহিত্যের এক জন জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার খোশবাসপুর গ্রামে উনিশশো ত্রিশ সালের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ চৌদ্দই অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন ৷

প্রথম জীবনে বাড়ি থেকে পালিয়েছেন। রাঢ় বাংলার লোকনাট্য “আলকাপের” সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাচ-গান-অভিনয়ে ডুবে থেকে জেলায় জেলায় ঘুরেছেন ৷

তিনি ছিলেন ‘আলকাপ’ দলের “ওস্তাদ” (গুরু)। নাচ-গানের প্রশিক্ষক। নিজে আলকাপের আসরে বসে হ্যাজাগের আলোয় দর্শকের সামনে বাঁশের বাঁশি বাজাতেন । নিজের দল নিয়ে ঘুরেছেন সারা পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, এমনকী বিহার-ঝাড়খণ্ডেও। তাই পরবর্তী জীবনে কলকাতায় বাস করলেও নিজেকে কলকাতায় প্রবাসী ভাবতেই ভালোবাসতেন।

তাই সুযোগ পেলেই বার বার মুর্শিদাবাদের গ্রামে পালিয়ে যেতেন। সেই পলাতক কিশোর তাঁর চরিত্রের মধ্যে লুকিয়ে ছিল।

তাঁর ইন্তি, পিসি ও ঘাটবাবু, ভালোবাসা ও ডাউনট্রেন, তরঙ্গিনীর চোখ, জল সাপ ভালোবাসা, হিজলবিলের রাখালেরা, নৃশংস, রণভূমি, মাটি, উড়োপাখির ছায়া, রক্তের প্রত্যাশা, মানুষের জন্ম, মৃত্যুর ঘোড়া, গোঘ্ন, রানীরঘাটের বৃত্তান্ত ইত্যাদি অসংখ্য ছোটগল্পের জন্য বিশ্বসাহিত্যের দরবারে স্থায়ী আসন পেয়েছেন ৷

পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এক ঝাঁক লেখক বাংলা সাহিত্যে উদিত হন, যেমন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যশোদাজীবন বন্দ্যোপাধ্যায়, রতন ভট্টাচার্য, স্মরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতি নন্দী এঁদেরই সঙ্গে আবির্ভাব ঘটে সিরাজের ।

তবে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল বিপুল, তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র ছিল দ্বারকা নদীর অববাহিকায় আদিম প্রবৃত্তিতে ভরা নারীপুরুষ ও উন্মুক্ত প্রকৃতি। এই এলাকার নাম ‘ হিজল’। কান্দী মহকুমার অন্তর্গত।

তাঁর ‘হিজলকন্যা” উপন্যাসে সেই অঞ্চলের নরনারীকে ধরা আছে । মুস্তাফা সিরাজ কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেন ষাটের দশকের শুরুতে।৷ দীর্ঘদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে চাকরি ও লেখালেখি সমান তালে চালিয়ে গেছেন।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখক সত্তায় জড়িয়ে ছিল রাঢ়ের রুক্ষ মাটি। মুর্শিদাবাদের পাশের জেলা বীরভূম, যেখানে লাভপুর গ্রামে তারাশঙ্করের জন্ম। একই জলহাওয়া তাঁদের দু’জনকেই প্রাণোন্মাদনা দিয়েছিল। তাই তারাশঙ্কর বলতেন, “আমার পরেই সিরাজ, সিরাজই আমার পরে অধিষ্ঠান করবে।”

তাঁর লেখা ‘তৃণভূমি” উপন্যাসে কান্দী মহকুমার এক বৃহৎ অঞ্চল ধরা আছে। “উত্তর জাহ্নবী” উপন্যাসে ধরা আছে এক বিশেষ সময় ও সমাজের কথা, যা বাংলা সাহিত্যে অনাস্বাদিত। আর “অলীক মানুষ” এক বিস্তৃত ভুবনের কাহিনী, যা এক মুসলিম পীর বা ধর্মগুরুর বংশে জাত পুরুষের আত্মানুসন্ধান। ব্রিটিশের রাজত্বের শেষ ভাগে এক পরিবর্তনীয় সময়ের নিখুঁত স্থির ছবি।

এই ‘অলীক মানুষ’ তাঁকে ভিন্ন লেখকের মর্যাদার চূড়ান্ত শিখরে উন্নীত করেছে । ক্ষুদে ও কিশোর পাঠকদের দাবি মেটাতে তিনি সৃষ্টি করলেন “গোয়েন্দা কর্নেল” নামে এক জন রহ্স্যময় চরিত্র, যাঁর মাথা জোড়া টাক, ঠোঁটে চুরুট, অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসার, এখন প্রজাপতি ও পাখি দেখতে ভালোবাসেন।

অথচ তিনি অনেক অপরাধ ও হত্যার কিনারা করে শখের গোয়েন্দাগিরি।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘অলীক মানুষ’ উপন্যাসটি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্কিম পুরস্কার  এ সব ছাড়াও ভুয়ালকা পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত।

তাঁর ‘অমর্ত্য প্রেমকথা’ বইয়ের জন্য জন্য তিনি পেয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত নরসিংহদাস স্মৃতি পুরস্কার।

এ ছাড়া উনিশশো উনআশি সালে পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার । তাঁর বেশ কিছু রচনা থেকে সিনেমা ও নাটক হয়েছে।

দুইহাজার বারো সালের চৌঠা সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আজ তার জন্মবার্ষিকীতে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সকল সদস্য, দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।

তারিখঃ- ১৪/১০/২০২১ ইং।

Facebook Comments