সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের জন্মবার্ষিকী আজ

অন্নদাশঙ্কর রায় এক জন স্বনামধন্য বাঙালি কবি ও লেখক। তিনি এক জন বিখ্যাত ছড়াকারও। উনিশ শতকের বাঙালি রেনেসাঁ ঐতিহ্যের শেষ বুদ্ধিজীবী হিসেবে অভিহিত।

অন্নদাশঙ্কর রায় জন্মগ্রহণ করেন ব্রিটিশ ভারতে বর্তমান ওড়িশার ঢেঙ্কানলে উনিশশো চার সালের আজকের এই দিনে অর্থাৎ পনেরোই মার্চ।

জমিদার হিসেবে অন্নদাশঙ্করের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন প্রজাহিতৈষী, মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী। তাঁদের পরিবারে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা হতো।

ছোটবেলায় ঢেঙ্কানলে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় । উনিশশো একুশ খ্রিস্টাব্দে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন । এর পর তিনি কটকের রাভেনশ কলেজ থেকে আই.এ পরীক্ষা দেন এবং তাতে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন । উনিশশো পঁচিশ খ্রিস্টাব্দে বি.এ পরীক্ষাতেও তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম স্থানাধিকারী হন।

উনিশশো সাতাশ খ্রিস্টাব্দে এম.এ পড়তে পড়তে আই.সি.এস পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় বারে পূর্ববর্তী রেকর্ড ভেঙে প্রথম স্থান অধিকার করেন । তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে এ গৌরব লাভ করেন। সেই বছরেই তিনি সরকারি খরচে আই.সি.এস হতে ইংল্যান্ড যান । সেখানে তিনি দুই বছর ছিলেন । এই সময়ে তাঁর ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী “পথে প্রবাসে” বিচিত্রায় প্রকাশিত হয় ।তিনি ঘুরে বেড়ান সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ইটালি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ। ফলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটে তাঁর সাহিত্যে।

অন্নদাশঙ্করের প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ তারুণ্য উনিশশো আটাশ সালে প্রকাশিত হয় “বিচিত্রা” পত্রিকায়। তবে তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা পথে প্রবাসে ভ্রমণকাহিনীর মাধ্যমেই তিনি বাংলা সাহিত্যে নিজের স্থান করে নেন।

বাংলা, ইংরেজি, ওড়িয়া, সংস্কৃত, হিন্দি-সব ভাষায় পারদর্শী হলেও বাংলাকেই তিনি সাহিত্যচর্চার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। বাড়ির ও কলেজের গ্রন্থাগারে তিনি ভারতীয় এবং ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হন।

উনিশশো বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালির আত্মদান তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। পরের বছর তিনি এক ঐতিহাসিক ‘সাহিত্য মেলা’র আয়োজন করেন শান্তিনিকেতনে।

তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এই সাহিত্য মেলায় যোগ দেন কাজী মোতাহার হোসেন, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, শামসুর রাহমান, কায়সুল হক এবং আরো অনেকে।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অন্নদাশঙ্কর রায় বিশ বছর বয়সে ওড়িয়া সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

তাঁর প্রথম কবিতা ওড়িয়া ভাষায় রচিত। কম বয়সে “প্রভা” নামে ওড়িয়া ভাষায় হাতে লেখা একটি পত্রিকা বের করেন।

প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত “সবুজপত্র” ছিল তাঁর লেখক হয়ে ওঠার প্রেরণা। সবুজপত্র পত্রিকার দুই প্রধান লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রমথ চৌধুরীর জীবনদর্শন ও শিল্পাদর্শ অন্নদাশঙ্করের সাহিত্য-মানস গঠনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে।

অন্নদাশঙ্কর রায় কোনো গোষ্ঠীভুক্ত লেখক ছিলেন না। তবে সম্পাদকদের অনুরোধে কল্লোল, কালিকলম, পরিচয় প্রভৃতি পত্রিকার জন্য লেখেন। কল্লোল, কালিকলম যুগের সাহিত্যিক এবং বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ও শিখা গোষ্ঠীর প্রতিভূদের সঙ্গেও তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল।

দীর্ঘজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রায় সত্তর বছর ধরে তিনি প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, ছড়া, কবিতা, নাটক, পত্রসাহিত্য, আত্মজীবনীমূলক রচনা প্রভৃতি লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। তাঁর রচিত উপন্যাসের সংখ্যা বাইশটি।

এর মধ্যে প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস আগুন নিয়ে খেলা। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহাকাব্যিক উপন্যাস তাঁর ছয় খন্ডে প্রকাশিত “সত্যাসত্য” ছয়টি নামে প্রকাশিত হয় যথাক্রমে- যার যেথা দেশ, অজ্ঞাতবাস, কলঙ্কবতী, দুঃখমোচন, মর্ত্যের স্বর্গ, অপসরণ।

ছয় খন্ডে রচিত “সত্যাসত্য” বাংলায় মননশীল উপন্যাস রচনায় এক স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করে। এ উপন্যাসের বিশাল পরিসরে রূপায়িত হয়েছে আধুনিক যুগের জটিল জীবন-সমস্যা, সামাজিক, দার্শনিক, রাজনৈতিক মতবাদ ও তত্ত্ব, দাম্পত্য সম্পর্কের আধুনিক ধারণা এবং দেশ-কালের বৃহত্তর আবহ। তাঁর বিশ্ববীক্ষা, সভ্যতার বিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতা ও মানবতাবাদী চিন্তাভাবনা রবীন্দ্রনাথেরই উত্তরাধিকার।

অন্নদাশঙ্করের সাহিত্যসৃষ্টি বৈচিত্র্যপূর্ণ। কেবল আঙ্গিকে নয়, ভাববৈচিত্র্যেও তাঁর রচনা কালোত্তীর্ণ। বহুমুখী ভাবানুভূতি তাঁর রচনার বিশেষত্ব। বিষয়বৈচিত্র্যে তাঁর রচনা সমৃদ্ধ। ইতিহাস, সাহিত্যতত্ত্ব, দর্শন, সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমকালীন বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ তাঁর গদ্যের বিষয়। প্রবন্ধসাহিত্যে অন্নদাশঙ্কর ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের সার্থক উত্তরসূরি।

তবে রবীন্দ্রযুগের লেখক হলেও তাঁর স্টাইল সম্পূর্ণ ভিন্ন।তিনি ছিলেন মুক্তচিন্তা, আদর্শবাদ ও শুভবুদ্ধির প্রতীক।দেশভাগ, দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী ছিল আজীবন সোচ্চার।কল্পনা ও যুক্তি,প্রেম ও বিবেক, স্বদেশ ভাবনা, বিশ্বচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতার সমন্বয় তাঁর প্রবন্ধসমূহ।

পরিণত বয়সে এসে তাঁর প্রবন্ধে সৃষ্টিশীলতা, শিল্পকলা ও সৌন্দর্যচেতনার পাশাপাশি যুক্ত হয় নৈতিকতা, ন্যায়বোধ, যুক্তিবাদ ও বিবেকবোধ।

অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাংলা ছড়াসম্ভার বিষয়বৈচিত্র্যে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথ এবং পরে বুদ্ধদেব বসুর অনুরোধে তিনি ছড়া লেখা আরম্ভ করেন। সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয় থেকে শুরু করে প্রাণীজগতের ক্ষুদ্র জীবজন্তুও স্থান পেয়েছে তাঁর ছড়ায়।

তীব্র শ্লেষে, স্নিগ্ধ পরিহাসে, আবার কখনো নিখাদ কৌতূকে তিনি মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের অসঙ্গতিগুলি তুলে ধরেন ছড়ার মাধ্যমে। একসময়ের ছেলেভুলানো ছড়াকে তিনি উপেক্ষিত স্তর থেকে উন্নীত করেন অভিজাত সাহিত্যের শৈল্পিক স্তরে। তাঁর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছড়া খোকা ও খুকু। এতে সুর দিয়েছেন বিখ্যাত সুরকার সলীল চৌধুরী। দেশবিভাগ জনিত বেদনা তীর্যকভাবে প্রকাশ পেয়েছে এই ছড়ায়।

তিনি ওড়িয়া ভাষায় চৌদ্দটি কবিতা, বাইশটি প্রবন্ধ, স্বপ্ন নামে একটি গল্প এবং কয়েকটি চিঠিপত্র লিখেছেন। ওড়িয়া সাহিত্যের “সবুজ যুগ”অধ্যায়ে তাঁর নামও অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া “বাসন্তী” নামের ওড়িয়া উপন্যাসের আদি তিনটি অধ্যায় তাঁর রচিত। ওড়িয়া ভাষায় অন্নদাশঙ্করের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকৃত ও আলোচিত হয়।

কর্মসূত্রে পূর্ববঙ্গে অতিবাহিত করার সময় এখানকার সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ভূমিব্যবস্থা এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর সম্যক ধারণা গড়ে ওঠে। বাংলা ভাষা ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষের প্রতি তাঁর দরদ ও সহমর্মিতা আজীবন অটুট ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অন্নদাশঙ্কর দু’বার এদেশে আসেন সরকারের অতিথি হিসেবে – প্রথমবার উনিশশো চুয়াত্তর সালে এবং দ্বিতীয়বার উনিশশো ছিয়ানব্বই সালে।

সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী পুরস্কারে ভূষিত করে উনিশশো উনআশি সালে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে প্রদান করে দেশিকোত্তম সম্মান। বর্ধমান, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি লিট উপাধি প্রদান করে।

তিনি মৃত্যুবরণ করেন আটাশে অক্টোবর দুহাজার দুই সালে।

আজ তার জন্মবার্ষিকীতে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সকল সদস্য দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি অজস্র ভালোবাসা এবং বিনম্র শ্রদ্ধা।

তারিখ:- ১৫/০৩/২০২১ ইংরেজি

Facebook Comments