লোকজ শব্দটি ‘লোক’ ধাতু হতে উদ্ভূত। যার সাধারণ অর্থ ‘জনগণ’। তাই ‘লোকজ’ শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ দাঁড়ায় ‘জনগণ হতে প্রাপ্ত’। লোকজ সংস্কৃতি মূলত জনগণ হতে প্রাপ্ত সংস্কৃতি । স্থানীয় পরিভাষায় লোকজ সংস্কৃতি হলো কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনসাধারণের বিভিন্ন আচার আচরণ, অভ্যাস, রীতি, ও উৎসব পদ্ধতির মধ্যকার এমন উপাদানাদি যার মাধ্যমে উক্ত অঞ্চলের জনসাধারণ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়।
আবহমান কাল থেকে এ লোকাচার ও লোকসংস্কৃতি মানুষের জীবনমান, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে অনুধাবন ও গবেষণার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে । যুগে যুগে মানবজাতির সামনে আবির্ভূত হওয়া নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে গিয়ে অগণিত ইতিহাসবিদ, গবেষক ও জ্ঞানপিপাসু শিক্ষানবিশ বারবার ফিরে এসেছে লোকজ সংস্কৃতির কাছে।
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও জ্ঞানবিজ্ঞানের শীর্ষে পৌঁছার দাবীদার মানবজাতি আজ দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়াল মৃত্যু উপত্যাকার সামনে। অর্থনৈতিক প্রতারণার ধোঁয়াশাপূর্ণ জালে আবদ্ধ মানবজাতির সামনে এখন অকল্পনীয় এক চ্যালেঞ্জ।
জীবনবিনাশি ভাইরাসের নেপথ্যে শোনা যায় দুর্ভিক্ষের হাহাকার। বর্তমান পৃথিবীর এ রহস্যপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রতারণার মোকাবেলা করাটাই এখন মানবজাতির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে । বরাবরের মতোই এ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে লোকজ সংস্কৃতির রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ।
প্রাগৈতিহাসিককালের মানবসমাজে মানুষকে তার প্রয়োজন পূরণের জন্য অনেকটা সবজান্তা হতে হতো । মূদ্রা আবিষ্কারের পূর্ববর্তী যুগে তারা খাদ্যের বিনিময়ে অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করতো। এরই ধারাবাহিকতায় প্রাচীন বাংলার লোকাচারে একসময় প্রচলন ঘটে চাল, গম, বার্লি, লবণ ইত্যাদি পণ্যের বিনিময় পদ্ধতি। পণ্য আদানপ্রদানের এক অভিনব ব্যবস্থা চালু হয় জীবনধারণের অপরিহার্য প্রয়োজন পূরণের তাগিদে। আধুনিক অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলা হয় ‘পণ্য বিনিময় ব্যবস্থা’ বা ‘বার্টার সিস্টেম’। মুদ্রার অনুপস্থিতিতে এ ব্যবস্থা বহুগুণ ভালো হলেও এর কিছু অসুবিধা রয়েছে। যেমন- যার চাল রয়েছে কিন্তু কাপড়ের প্রয়োজন তাকে এমন লোক খুঁজতে হবে যার কাপড়ের বদলে চাল প্রয়োজন। কালক্রমে অতীত বঙ্গে ধীরে ধীরে প্রচলন ঘটে অন্যান্য মূদ্রার । মূদ্রা হিসেবে কড়ির ব্যবহার বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যের একটা সুদীর্ঘ স্থান দখল করে আছে। নব্য প্রাচীন বংগ হতে শুরু করে ১৯ শতক পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মুদ্রার নিম্নতম একক হিসেবে কড়ি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যবহৃত স্বর্ণ ও রৌপ্যমূদ্রার প্রচলন ছিল খ্রিস্টিয় ৫ম শতক হতে। এরপর থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রীয় মুদ্রা হিসেবে স্বর্ণ , রূপা ও তামার তৈরী বিভিন্ন ধাতব মুদ্রা প্রচলনের প্রমাণ পাওয়া যায়।
১ম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বর্ণ ও রূপার তৈরী ধাতব মূদ্রা প্রচলনে ভাটা পড়তে থাকে। ১৯৩৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণমুদ্রা নিষিদ্ধ হয়ে গেলে বিভিন্ন দেশে কাগুজে মুদ্রার প্রাধান্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। কাগুজে মুদ্রার ব্যপকতার কারণে একসময় ধাতব মুদ্রা হিসেবে রৌপ্যমুদ্রাও বন্ধ হয়ে যায়। পুঁজিবাদি অর্থব্যবস্থায় মানবজাতিকে দাসত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ করার শ্রেষ্ঠতম হাতিয়ার হিসেবে ধাতব মুদ্রার পরিবর্তে বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন কাগুজে মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়।
পণ্য বিনিময় ব্যবস্থা ও ধাতবমুদ্রা ব্যবস্থা চলাকালীন সময়ে মানবজাতি দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ না হলেও কাগুজে মুদ্রা তা সফলতার সাথে করতে পেরেছে । কারণ বার্টার সিস্টেম ও ধাতব মুদ্রার ব্যবহারে কোন মূদ্রাস্ফীতির সুযোগ ছিলনা। ফলে তখন অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে বাজারের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। বার্টার সিস্টেমে কোন নির্দিষ্ট মুদ্রার ব্যবহার নেই বলে এতে মূদ্রাস্ফীতির প্রসংগ অবান্তর। অপরদিকে ধাতব মুদ্রা হিসেবে স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা’র ব্যবহারে মুদ্রাস্ফীতির কোন সুযোগ ছিলনা। কারণ স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা ছিল প্রকৃত মুদ্রা।
যে মুদ্রার নিজের মান নিজের মধ্যেই নিহিত তাকে প্রকৃত মুদ্রা বলা হয়। অপরদিকে যে মুদ্রার নিজের মান নিজের মধ্যেই নিহিত থাকেনা তাকে কৃত্রিম মুদ্রা বলা হয়। কাগুজে মুদ্রা যেহেতু প্রকৃত মুদ্রা নয় বরং কৃত্রিম মুদ্রা তাই এর কোন নির্দিষ্ট ধ্রুব মান নেই। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী পুঁজিবাদি গোষ্ঠির হস্তক্ষেপের একটি অভাবনীয় সুযোগ সৃষ্টি হয়ে গেল এই প্রতারণাপূর্ণ কৃত্রিম মুদ্রা প্রচলনের মধ্য দিয়ে। কাগুজে মুদ্রার এই পরিবর্তনশীল মান এখন সম্পূর্ণরূপে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী একটি প্রভাবশালী শ্রেণির কব্জায় চলে আসে। মুদ্রাস্ফীতি নামক অদৃশ্য দানবের কবলে পড়ে যায় মানবজাতি। বিষয়টি পরিষ্কার করতে ১টি দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে।
ধরা যাক আপনার দাদা ১৯৭১ সালে একজন ব্যক্তির কাছে আপনার জন্য ১০০ স্বর্ণমুদ্রা গচ্ছিত রাখলো। ঐ ব্যক্তি তা (কাগুজে মুদ্রা) ইউ এস ডলারে রূপান্তর করে রাখতে চাইল। সে তখন ১০০ স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে পেল ৩৫০০ ডলার। ২৫ বছর পর ১৯৯৬ সালে আপনি আপনার প্রাপ্য অর্থ ফেরত চাইলেন। আপনাকে ৩৫০০ ডলার ফেরত দিলে আপনি বাজারে গিয়ে তা প্রকৃত মুদ্রায়/ স্বর্ণমুদ্রায় রূপান্তর করতে চাইলেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশার বিষয় হলো আপনি তখন ৩৫০০ ডলারের বিনিময়ে পেলেন মাত্র ৮টি স্বর্ণমুদ্রা । কারণ ডলার কোন প্রকৃত মুদ্রা নয়। এটি একটি কৃত্রিম মুদ্রা হওয়ার কারণে এর মান ২৫ বছরে মুদ্রাস্ফীতির কারণে পরিবর্তিত হয়ে ৯২% কমে গেছে। আপনার এই ৯২% ক্ষতিই মূলত লুণ্ঠনকারী পুঁজিবাদীদের ৯২% মুনাফা। অপরদিকে ঐ ব্যক্তি যদি ১০০ স্বর্ণমুদ্রা কাগুজে মুদ্রায় রূপান্তর না করে স্বর্ণমুদ্রা হিসেবে রেখে দিতো, তবে ২৫ বছর পর আপনাকে ১০০ স্বর্ণ মুদ্রা’ই ফেরত দেয়া সম্ভব হতো। এতে সময়ের ব্যবধানে উক্ত মুদ্রার মান কমতোনা বা বাড়তোনা। কারণ এটি হলো প্রকৃত মুদ্রা। এর মান নিজের মধ্যেই নিহিত থাকতো।
এমনিভাবে একটা দীর্ঘ সময় যাবৎ মানবজাতির ওপর পুঁজিবাদি অর্থনীতির অদৃশ্য শৃংঙ্খল, দাসত্বের বেড়ি পড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি নামক অদৃশ্য দানবের মুখোমুখি করে দিয়েছে। কাগুজে মুদ্রা নামক কৃত্রিম মুদ্রা ব্যবহারের এ ধারা ক্রমাগত চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে মানবজাতিকে এক শোচনীয় পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে ।
বিশ্বব্যপী জীবনবিনাশী ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকবলিত অনেক দেশ ইতোমধ্যে কাগুজে মুদ্রার পরিবর্তে বিট কয়েন, ক্রিপ্টো কয়েন ইত্যাদি ইলেকট্রনিক মুদ্রার ব্যবহার শুরু করেছে। অথচ তা একদিকে যেমন প্রকৃত মুদ্রা নয় বরং কৃত্রিম মুদ্রা অপরদিকে এই নবআবিষ্কৃত ইলেকট্রনিক মুদ্রার মুদ্রাস্ফীতি কাগুজে মুদ্রার তুলনায় কয়েক হাজার গুণ পর্যন্ত হওয়া সম্ভব।
তাই আমাদের এখন মানবজাতিকে এ অদৃশ্য দাসত্ব হতে মুক্ত করার জন্য আত্মনিয়োগ করার সময় এসেছে । আমাদের এখন উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে ‘‘প্রকৃত মুদ্রার নিজস্ব মূল্য আছে কিন্তু কাগুজে বা ইলেকট্রনিক মুদ্রারূপী কৃত্রিম মুদ্রার নিজস্ব কোন মূল্য নেই’’। এর বাজারদর নির্দিষ্ট পরিমাণে ততদিনই টিকে থাকবে যতদিন বাজারে এর চাহিদা থাকবে। আর চাহিদা সর্বদাই দুপক্ষের সম্পর্ক, আস্থা, ও বিশ্বস্ততার ওপর নির্ভরশীল। মানবজাতিকে মুদ্রাস্ফীতি নামক এ দানবের কবল থেকে রক্ষা করতে আমাদের অনতিবিলম্বে প্রকৃত মুদ্রা অথবা বার্টার সিস্টেমের কাছে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু স্বর্ণ ও রূপার তৈরী প্রকৃত মুদ্রা সহজলভ্য নয় বলে দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য বার্টার সিস্টেমই সর্বশেষ ভরসা।
তাই এখন লোকসংস্কৃতির এ প্রাচীনতম উপাদানটিকে সযত্নে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার সময় এসেছে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে এর মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে আসন্ন অর্থনৈতিক ধ্বসের মোকাবেলায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। কিছুটা অসুবিধা থাকা স্বত্ত্বেও পণ্য বিনিময় ব্যবস্থার প্রচলনকে সহজসাধ্য করে তুলতে লোকজ সংস্কৃতির উন্নয়ণে কাজ করা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে হবে। বার্টার সিস্টেমের প্রায়োগিক দিক নিয়ে বিভিন্ন চিত্রনাট্য, চলচ্চিত্র, পুঁথি, পালা, গম্ভীরা, লোকগান, গল্প ও বিভিন্ন পরিবেশনা তৈরী করে সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণকে মুদ্রাস্ফীতির ভয়াল প্রভাবকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সহায়তা করা এখন সময়ের দাবি। এমনিভাবে সামগ্রিক পরিসরে আমাদের পক্ষে আবারো বার্টার সিস্টেম চালু করা সম্ভব হলে হয়তো মানবজাতি আবারো আগামি দিনের আসন্ন মুদ্রাস্ফীতির ভয়াল থাবা হতে কিছুটা হলেও রেহাই পাবে।
মোঃ জোবায়ের হোসেন
(উপদেষ্টা, লোসাস)
সহকারী শিক্ষক
দক্ষিণ পাইন্দং উচ্চ বিদ্যালয়
পাইন্দং, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।