বিখ্যাত চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের জন্মবার্ষিকী আজ

বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান। উনিশশো একাত্তর সালে ইয়াহিয়ার দানবমূর্তি সম্বলিত পোস্টার এবং বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সামরিক স্বৈরাচারকে নিয়ে কার্টুনচিত্র ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’ পোস্টার এঁকে কামরুল হাসান বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেন।

কামরুল হাসান উনিশশো একুশ সালের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ দোসরা ডিসেম্বর বর্ধমান জেলার কালনা থানার নারেঙ্গা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম এ.এস.এম. কামরুল হাসান অর্থাৎ আবু শরাফ (শার্ফ) মোহাম্মদ কামরুল হাসান।

উনিশশো ত্রিশ সালে কলকাতার তালতলাস্থ ইউরোপীয়ন এসাইলাম লেনে অবস্থিত মডেল এম.ই. স্কুলের ইনফ্যান্ট ক্লাস থেকেই কামরুল হাসানের বিদ্যাশিক্ষার শুরু হয়। এ স্কুলে কামরুল হাসান ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। এরপর কামরুল হাসান  উনিশশো সাঁইত্রিশ সালে বাবার আগ্রহে কলকাতা মাদ্রাসার অ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। স্কুল ও মাদ্রাসায় পড়ার সময় তিনি প্রচুর ছবি আঁকতেন। তাঁর তিনরঙা একটি ছবি মাদ্রাসার বার্ষিক ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল।

এরপর উনিশশো আটত্রিশ সালের জুলাই মাসে কামরুল হাসান কলকাতার ‘গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টস’-এ ভর্তি হন এবং চারুকলা বিভাগ থেকেই উনিশশো সাতচল্লিশ সালে তিনি ডিপ্লোমা অর্জন করেন।

তিনি উনিশশো উনসত্তর সালে আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়ার মুখের ছবি দিয়ে আঁকা পোস্টারটি খুব বিখ্যাত। কামরুল হাসান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও রেডিও এর কলা বিভাগের পরিচালক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।

উনিশশো সত্তর সালের নভেম্বরে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলে শিল্পী কামরুল হাসান অসহায় মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান।

উনিশশো একাত্তর সালের শুরু থেকেই রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। উনিশশো একাত্তর সালের পহেলা মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েন।

উনিশশো একাত্তর সালের সাতই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের পর সর্বত্র প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। ঢাকায় হাতিরপুল এলাকায় প্রতিরোধ কমিটির চেয়ারম্যান হন শিল্পী কামরুল হাসান।

উনিশশো একাত্তর সালে ইয়াহিয়ার দানবমূর্তি সম্বলিত পোস্টার এঁকে কামরুল হাসান বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেন। এখানে কামরুল হাসানের নেতৃত্বে কাজ করেন শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু, জহির আহমদ প্রমুখ। এই শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রচনা করেন একাধিক পোস্টার। এসব পোস্টারের মাধ্যমে পাকবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে যেমন তীব্র ধিক্কার ও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের মনে দেশের জন্য যুদ্ধের উৎসাহ ও উদ্দীপনাও সৃষ্টি হয়। এসব পোস্টারের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ-কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়ার দানবমূর্তি বিষয়ক কার্টুন সম্বলিত পোস্টারটি। পোস্টারটির ভাষা ছিল এইরূপঃ (বাংলায়) এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে। সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এই পোস্টারটি যেন সম্পৃক্ত হয়ে আছে।

উনিশশো বাহাত্তর সালে কামরুল হাসান তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে শিবনারায়ণ দাশ কর্তৃক ডিজাইনকৃত জাতীয় পতাকার বর্তমান রূপ দেন।

উনিশশো অষ্টাশি সালের দোসরা ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার সকালে শিল্পী কামরুল হাসান একটি কবিতা উৎসবে যোগ দেন। সারাদিন তিনি সেখানেই অবস্থান করেন।

বিকেলের স্বরচিত কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে তিনি সভাপতিত্ব করছিলেন এবং বসে বসে কবিতা শুনছিলেন এবং হাতের কাছে যা পাচ্ছিলেন তাতেই এঁকে যাচ্ছিলেন কিছু একটা।

এভাবেই কবি রবীন্দ্র গোপের ডায়রির পাতায় আঁকেন সেসময়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সামরিক স্বৈরাচারকে নিয়ে কার্টুনচিত্র দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে।

জীবিকাসূত্রে কামরুল হাসান উনিশশো আটচল্লিশ থেকে উনিশশো ষাট খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেন এবং উনিশশো ষাট থেকে উনিশশো আটাত্তর খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের নকশা কেন্দ্রের পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

কাঠখোদাই মাধ্যমে কাজ করছেন কামরুল হাসান
এছাড়া উনিশশো একাত্তর খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগের শিল্প বিভাগের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। দেশে-বিদেশে বহু একক এবং যৌথ চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন কামরুল হাসান।

চিত্রকলায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি  প্রেসিডেন্ট’স গোল্ড মেডাল, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, বাংলাদেশ চারু শিল্পী সংসদ সম্মাননা, বাংলা একাডেমীর ফেলো পুরস্কার লাভ করেন।

উনিশশো অষ্টাশি সালের দোসরা ফেব্রুয়ারি তারিখে কামরুল হাসান জাতীয় কবিতা উৎসবে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত থাকাকালীন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

পরের দিন অর্থাৎ তিন ফেব্রুয়ারি বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ চত্বরে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

আজ তার জন্মবার্ষিকীতে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা জানাচ্ছি।

তারিখঃ- ২/১২/২০২১ ইং।

Facebook Comments