ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে, এইখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।
অথবা
“অন্ধকারে যে বাস করে মৃদু আলোতে তাহার চোখ ঝলসাইয়া যায়।”
কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ এর মাঝে আমরা খুঁজে পাই এমন চিন্তার খোরাক জাগানো কিছু উক্তি।
উপন্যাসটির লেখক ছিলেন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
উনিশশো আট সালের উনিশে মে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে মানবিক মূল্যবোধের চরম সংকটময় মুহূর্তে বাংলা কথাসাহিত্যে যে কয়েক জন লেখকের হাতে বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয়, তাঁদের মধ্যে অন্যতম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁর রচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, নিয়তিবাদ ইত্যাদি।
মাত্র আটচল্লিশ বছরের জীবনে তিনি রচনা করেন বিয়াল্লিশটি উপন্যাস ও দুই শতাধিক ছোট গল্প।
তাঁর রচিত পুতুলনাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মা নদীর মাঝি ইত্যাদি উপন্যাস ও অতসী মামি, প্রাগৈতিহাসিক, ছোটবকুলপুরের যাত্রী ইত্যাদি গল্প সংকলন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে বিবেচিত হয়।
বাংলা ছাড়াও তাঁর রচনাসমূহ বহু বিদেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
পিতার বদলির চাকরির সূত্রে মানিকের শৈশব, কৈশোর ও প্রথম যৌবনের ছাত্র জীবন অতিবাহিত হয় বাংলা বিহার ওড়িশার দুমকা, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি শহরে।
তাঁর মা নীরদাসুন্দরীর আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের গাউদিয়া গ্রামে। এই গ্রামটির পটভূমি তিনি রচনা করেন তার প্রসিদ্ধ উপন্যাস ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের কারণে এখানকার সকল মানুষের জীবনচিত্র সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা ছিল মানিকের। তাই এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনচিত্রকে তাঁর সাহিত্যে অপূর্ব দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।
পদ্মার তীরবর্তী জেলেপাড়ার পটভূমিতে রচনা করেন পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসটি।
তাঁর প্রথম গল্পগুচ্ছ অতসী মামি ও অন্যান্য সংকলনে সব কয়টি গল্প এবং প্রথম উপন্যাস দিবারাত্রির কাব্য মধ্যবিত্ত জীবনভিত্তিক কাহিনি নিয়ে গড়া। এ ছাড়া গ্রামীণ হতদরিদ্র মানুষের জীবনচিত্রও তাঁর বেশ কিছু লেখায় দেখতে পাওয়া যায়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যাযয়ের সাহিত্যে বস্তুবাদের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। মনুষ্যত্ব ও মানবতাবাদের জয়গানই তাঁর সাহিত্যের মুল উপজীব্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের ভাঙাগড়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবকে তিনি তাঁর সাহিত্যে চিত্রায়িত করেছেন।
সমাজের শাসক ও পুঁজিপতিদের হাতে দরিদ্র সমাজের শোষণবঞ্চনার স্বরূপ তুলে ধরেছেন সাহিত্যের নানান চরিত্রের আড়ালে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বমোট চল্লিশটি উপন্যাস এবং তিনশোটি ছোট গল্প রচনা করেছেন। তার লেখা অন্যতম সেরা একটি ছোটগল্প হলো ‘মাসি পিসি’।
উনিশশো ছাপান্ন খ্রিস্টাব্দের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ তেসরা ডিসেম্বর বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী এই কথাসাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে।
আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সকল সদস্য দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।
তারিখঃ- ৩/১২/২০২১ ইং।