বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতির অন্যতম নিবেদিতপ্রাণ অগ্রজ প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান এর জন্মবার্ষিকী আজ

অসাম্প্রদায়িকতা, উদার গণতন্ত্র, ইহজাগতিকতা, মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, প্রগতি ও ন্যায় বিচারের আদর্শের ধারক ও বাহক আনিসুজ্জামান ছিলেন বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতির একজন পথপ্রদর্শক।

 

দুই বাংলার সংস্কৃতি জগতে আনিসুজ্জামানের পদস্পর্শ ছিল অবাধ এবং তাঁদের সবাইকেই তিনি সহৃদয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেছেন আজীবন।

 

বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, থিয়েটার, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, ছায়ানট, উদীচী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কিংবা বিশ্বভারতী—এসব সংগঠনের প্রতিটিই ছিল তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা ও স্নেহধন্য।

 

সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। এদের সবার কাছ থেকে তিনি সম্মান ও স্বীকৃতিও পেয়েছেন যথেষ্ট। বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, আনন্দ পুরস্কার, ভারতের পদ্মভূষণসহ নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে তাঁকে ভূষিত করা হয়েছিল।

 

দেশ-বিদেশে এত খ্যাতি সত্ত্বেও তিনি সর্বদাই মাটির কাছাকাছি বিচরণ করেছেন এবং ভেবেছেন ও বলেছেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক।’

 

আনিসুজ্জামানের প্রধান এবং প্রথম পরিচয় সম্ভবত ‘শিক্ষক’। শিক্ষকতা ও গবেষণাই ছিল তাঁর প্রধান বৃত্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছাত্র চিরকাল তাঁকে মনে রাখবেন, হৃদয়ে ধারণ করে রাখবেন।

 

জীবনের শেষে প্রান্তে এসে তিনি বাংলাদেশের ‘জাতীয় অধ্যাপক’ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

 

এই পদ তাঁর জন্য শুধু একটা সম্মানজনক পদ বা সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না। যুক্তি ও মনীষা দিয়ে জাতির প্রতিটি সংকটকালে অভিভাবকের মতো জাতিকে পথ দেখিয়েছেন তিনি, জাতীয় শিক্ষকের মতো, তিনি জাতির পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বারবার। অকুণ্ঠচিত্তে অসাম্প্রদায়িকতা, উদারনৈতিক গণতন্ত্র, ন্যায় বিচার এবং প্রগতির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।

 

তিনি ছিলেন ’৭২ সালে রচিত সংবিধানের মূল চার নীতির একনিষ্ঠ দৃঢ় সমর্থক। এসব নীতিতে কোনো গোঁজামিল তাঁর পছন্দ ছিল না। সেসব কথা নির্ভয়ে অনেকবার অনেক জায়গায় একাধিকবার তিনি উচ্চারণ করে গেছেন।

 

পাকিস্তানি শাসনের সেই অন্ধকার প্রতিক্রিয়াশীল যুগে রবীন্দ্রনাথকে সামনে তুলে ধরা, হাজার বছরের বাঙালি সত্তাকে যুক্তি ও তথ্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা এবং তদানীন্তন পূর্ব-বাংলার স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণের ক্ষেত্রে আনিসুজ্জামান সর্বদাই ছিলেন গভীরভাবে সচেতন এবং প্রবলভাবে সক্রিয়।

 

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আনিসুজ্জামান সোজা গিয়ে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর ভক্সওয়াগন গাড়িতে করে আগরতলায় এসে।

 

সেখানে গাড়িটি তদানীন্তন কমিউনিস্ট নেতাদের ব্যবহারের জন্য উপহার হিসেবে দান করে চলে আসেন কলকাতায়।

 

কাজ শুরু করেন মুজিবনগর সরকারের অধীনে পরিকল্পনা কোষে। তিনি হয়ে ওঠেন মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকারপ্রধান তাজউদ্দীন আহমদের অন্যতম সহচর। সেই দুঃসময়ে তাজউদ্দীন আহমদের অনেক ভাষণের প্রথম খসড়াটি তাঁর কলমেই রচিত হয়েছিল।

 

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়ে তিনি কাজ করেছেন নানাভাবে। একসময় বঙ্গবন্ধু তাঁকে শিক্ষাসচিবের পদও দিতে চেয়েছিলেন। এই প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে আনিসুজ্জামান তাজউদ্দীন আহমদকে অনুরোধ করেন তা বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়ে বলার জন্য।

 

তখন তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘আনিসুজ্জামানকে শিক্ষাসচিব করলে আমরা এজন ভালো শিক্ষককে হারাব আর বদলে পাব একজন মন্দ প্রশাসক।’ ——–(বিপুলা পৃথিবী)

 

এ কথা থেকে বোঝা যায় আনিসুজ্জামান কখনোই প্রশাসক জাতীয় কিছু হতে চাননি। তিনি চেয়েছেন নিজেকে সর্বদা জ্ঞানসাধনায় ব্যাপৃত রাখতে।

 

জ্ঞানের আলোয় প্রদীপ্ত পথ ধরেই হেঁটেছেন অবিচলভাবে।

স্বাধীন বাংলাদেশে ’৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, তার প্রায় পুরোটাই বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন আনিসুজ্জামান।

 

আজ এই গুণী মানুষটির জন্মবার্ষিকী। উনিশশো সাঁইত্রিশ সালের আঠারোই ফেব্রুয়ারী তিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

 

লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন এর সকল সদস্য, দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে প্রিয় মানুষটির জন্মবার্ষিকীতে জানাই অজস্র ভালোবাসা এবং বিনম্র শ্রদ্ধা।

 

তাঁর সকল ইতিবাচক কাজ, চিন্তা ও লেখনী আগামী দিনের একটি মানবিক সমাজের অন্বেষণে আমাদের সবার পাথেয় হিসেবে কাজ করুক এটাই আমাদের সকলের আন্তরিক কামনা।

তারিখ:- ১৮/০২/২০২১ ইংরেজি

Facebook Comments