শোন ভাই আজগুবি খবর
মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন করে চট্টগ্রাম সফর।
দিনের তিনটা বেজে গেল পল্টনে সভা বসিল
হায় কি দেখিলাম কি ঘটিল।
মানুষ ভয়ে জড়সড়
হঠাৎ দেখি পচা আণ্ডা
মন্ত্রীকে করিতেছে ঠাণ্ডা।
উড়তে লাগলো কাল ঝাণ্ডা,
মন্ত্রীর চোখের উপর।
বিপ্লবী চট্টগ্রাম গেলা সূর্যসেনের প্রধান কেল্লা
মন্ত্রী করে তৌব্বা তিল্লা,
করবো না জনমভরে চট্টগ্রাম শহর।
এই গানটি এতো জনপ্রিয় পেয়েছিল যে তা সাড়াদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং এই জন্য তাকে কারাগারে নেওয়া হয়।
বলছি বাংলা কবিগানের অন্যতম রূপকার রমেশ শীল বা কবিয়াল রমেশ শীল বা রমেশ মাইজভান্ডারী এর কথা।
কবিগানের লোকায়ত ঐতিহ্যের সাথে আধুনিক সমাজ সচেতনতার সার্থক মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন মাইজভান্ডারী গানের কিংবদন্তি সাধক।
কবিয়াল রমেশ শীল আঠারোশো সাতাত্তর সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের বোয়ালখালি থানার অন্তর্গত গোমদন্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি একজন অসাধারণ স্বভাবকবিও ছিলেন এবং গানের আসরে তাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে গান রচনা করে গাইতেন।
কবিয়াল হিসেবে রমেশ শীলের খ্যাতি আঞ্চলিক সীমা ছাড়িয়ে বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তিনি উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত কবির লড়াইয়ের আসরে শেখ গুমানীকে পরাজিত করে শ্রেষ্ঠ কবিয়ালের মর্যাদা লাভ করেন।
ঐতিহ্যগতভাবে কবিগানের প্রধান বিষয় পৌরাণিক হলেও রমেশ শীল সমকালের নানা ঘটনা এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাকে গানের বিষয়বস্তু করতেন।
তাঁর জীবৎকালে সংঘটিত অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন, চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, সূর্যসেনের আত্মাহুতি, দুর্ভিক্ষ, দেশবিভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, ভাষা আন্দোলন, সামাজিক অবিচার, দুর্নীতি, মহাজনি শোষণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তিনি গান বেঁধেছেন এবং সেসব গেয়ে জনগণের মনে প্রতিবাদী ও সংগ্রামী চেতনা জাগ্রত করেছেন।
পূর্বে কবিগান ছিল কেবল চিত্তবিনোদনের মাধ্যম, কিন্তু রমেশ শীল একে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ারে পরিণত করেন।
রমেশ শীলের অপর কৃতিত্ব মাইজভান্ডারি গান রচনা ও তা গেয়ে জনপ্রিয় করে তোলা। চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারি তরিকার প্রবর্তক সৈয়দ আহমদুল্লাহ এর গুণকীর্তন ও এ ধারার আধ্যাত্মিক মহিমা তুলে ধরে তিনি বহু গান রচনা করেন।
তাঁর এ জাতীয় গানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশ। গানগুলি বিভিন্ন সময়ে আশেকমালা, শান্তিভান্ডার, মুক্তির দরবার, নূরে দুনিয়া, জীবনসাথী,সত্যদর্পণ, ভান্ডারে মওলা,মানববন্ধু ও এস্কে সিরাজিয়া এই নয়টি পুস্তকে প্রকাশিত হয়েছে।
মাইজভান্ডারির গদিনশিন পীর সৈয়দ গোলামুর রহমান তাঁর সমসাময়িক ছিলেন। রমেশ শীল এ তরিকায় দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং আন্তঃপ্রেরণাবশে এ ধারার সাধনসঙ্গীত রচনা করেন।
এজন্য স্বসমাজে তিনি নিন্দিত হন, এমনকি একঘরে হয়ে জীবন কাটান। মৃত্যুর পর তাঁকে দাহ না করে কবর দেওয়া হয়।
রমেশ শীল প্রকৃত দেশপ্রেমিক অসাম্প্রদায়িক ও মুক্ত মনের অধিকারী ছিলেন।
হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান বৌদ্ধ সকল ধর্মের এক কথা, মাটির মূর্তির পূজা ছেড়ে মানুষ পূজা কর’ এসব তাঁরই সাহসী উক্তি।
রমেশ শীলের গানের গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত ‘চলরে মন ত্বরাই যাই, বিলম্বের আর সময় নাই/ গাউছুল আজম মাইজভান্ডারি স্কুল খুলেছে’ গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছে।
উনিশশো বাষট্টি সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমী রমেশ শীলকে শ্রেষ্ঠ লোককবির সম্মানে ভূষিত করে। উনিশশো চৌষট্টি সালে চট্টগ্রামের নাগরিক সংবর্ধনায় ভূষিত হন।
এরপর দুহাজার দুই সালে গণসংগীতের জন্য একুশে পদক অর্জন করেন।
উনিশশো সাতষট্টি সালের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ ৬ই এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সকল সদস্য দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।
তারিখ:- ০৬/০৪/২০২১ ইংরেজি