ডালে ডালে পাখীর বাসা
মিষ্টি মধুর পাখীর ভাষা
সাত সাগরে নদীর বাসা
কুলুকুলু নদীর ভাষা।
হাজার সুরে হাজার ভাষায়
এ দুনিয়া ঘেরা
আর মাতৃভাষা বাংলা আমার
সকল ভাষার সেরা।
কবিতাঃ- ভাষার গান
কবিঃ-[ফররুখ আহমদ]
সৈয়দ ফররুখ আহমদ একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী কবি। তিনি ‘মুসলিম রেনেসাঁর কবি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তার কবিতায় বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অণুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর এই কবি ইসলামি ভাবধারার বাহক হলেও তার কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাক্প্রতিমার অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।
আধুনিকতার সকল লক্ষণ তার কবিতায় পরিব্যাপ্ত। তার কবিতায় রোমান্টিকতা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের ধারাবাহিকতা পরিস্ফুট।
‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থে তিনি যে কাব্যভাষার সৃষ্টি করেছেন তা স্বতন্ত্র এবং এ-গ্রন্থ তার এক অমর সৃষ্টি।
সৈয়দ ফররুখ আহমদের জন্ম উনিশশো আঠারো সালের দশ জুন মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামের সৈয়দ বংশে। তার বাবা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর।
ফররুখ আহমদ খুলনা জিলা স্কুল থেকে উনিশশো সাঁইত্রিশ সালে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে উনিশশো উনচল্লিশ সালে আই.এ. পাস করেন।
এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।
ছাত্রাবস্থায় তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। তবে চল্লিশ-এর দশকে তার রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে। তিনি ভারত বিভাগ তথা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেন।
উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালে তিনি মাসিক মোহাম্মদীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
তবে শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে চাকরি করেন ঢাকা বেতারে। দেশ বিভাগের পর উনিশশো আটচল্লিশ সালে ফররুখ আহমদ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন।
এখানেই প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে উনিশশো বাহাত্তর সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় ‘কবি’। ফররুখ আহমদ সনেটও রচনা করেছেন।
তার রচনায় ধর্মীয় ভাবধারার প্রভাব দেখা যায়। এছাড়া আরবি ও ফারসি শব্দের প্রাচুর্য তার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলামি ঐতিহ্যের প্রতি ছিল তার অগাধ আস্থা।
তবে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার সমর্থন করতেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই কবি ফররুখ আহমদ মাসিক সওগাতের তিনি লেখেন,
‘গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে পর্যন্ত যাঁরা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে চান তাঁদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সাথে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
তার রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সাত সাগরের মাঝি,সিরাজাম মুনীরা,নৌফেল ও হাতেম, মুহূর্তের কবিতা,ধোলাই কাব্য,হাতেম তায়ী,নতুন লেখা,কাফেলা,হাবিদা মরুর কাহিনী,
সিন্দাবাদ,দিলরুবা প্রভৃতি।
এছাড়াও তিনি কিছু শিশুতোষ গ্রন্থও রচনা করেন যেগুলোর মধ্যে অন্যতম পাখির বাসা,হরফের ছড়া,
চাঁদের আসর, ছড়ার আসর,ফুলের জলসা প্রভৃতি।
উনিশশো ষাট সালে ফররুখ আহমদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি উনিশশো পঁয়ষট্টি সনে প্রেসিডেন্ট পদক প্রাইড অব পারফরমেন্স এবং উনিশশো ছেষট্টি সালে পান আদমজী সাহিত্য পুরস্কার ও ইউনেস্কো পুরস্কার।
উনিশশো সাতাত্তর ও উনিশশো আশি সালে তাকে যথাক্রমে মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক প্রদান করা হয়।
ফররুখ আহমদ উনিশশো চুয়াত্তর সালের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ উনিশে অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সকল সদস্য দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।
তারিখঃ- ১৯/১০/২০২১ ইং।