- পরিবেশ রক্ষায় লোকজ সংস্কৃতি:
“লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন” কে যেদিন মনে প্রাণে আপন ভেবে নিজেকে পুরোপুরি বিলীন করে দেওয়ার মতো হঠকারী সিদ্ধান্তে গিয়েছিলাম তখনকার ঠিক ওই মুহুর্তটিকে আমি আমার স্মৃতিতে বন্দি করে রাখতে পারিনি।
লোকজ সংস্কৃতি নিয়ে যেহেতু চিন্তা করি বা এখন দায়িত্ববোধ থেকে আর অন্যান্যদের অনুপ্রাণিত করতে যখন নানারকম প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয় তখন মাঝে মাঝেই নিজেকে বর্তমান অবস্থার সাথে লোকজ সংস্কৃতিকে মিলিয়ে নিতে দিনের বেশিরভাগ সময়টাতেই “লোকজ সংস্কৃতি” নিয়ে মস্তিষ্কে ঝড় তুলতে হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় “লোকজ সংস্কৃতি” কে মূল ধরে জীবনের বিভিন্ন দিকের সাথে এটির মেলবন্ধন করার চেষ্টা করে বিভিন্ন দিক নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লেখার দুঃসাহসিক অভিযানে নেমেছি।
“লোকজ সংস্কৃতি” নিয়ে আমার জ্ঞান এখনো শূন্যের কোঠায়। আর আমাদের দেশের এইক্ষেত্রটি এমন ই সংকটাপন্ন যে এটি নিয়ে খুব সহজেই কারো সাথে আলাপচারিতা শুরু করে দেওয়া যায় না অথবা গভীরভাবে পড়ালেখা শুরু করার জন্য বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির সকল কিছু হাতের মুঠোয় থাকার পর ও আংগুলের দুটি টোকায় আমার হাতের মুঠোয় থাকা যন্ত্রটি থেকে এ সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের জন্য বিশাল পরিমাণের কোন তথ্যভান্ডার ও এক নিমেষেই কাঁচের দেয়ালে এসে ভীড় করে না।
তো যা বলছিলাম, এই কারণেই এখনো আমি এই বিষয়ে লেখার ক্ষেত্রে দুঃসাহস দেখিয়ে নিজের কিছু পর্যবেক্ষণ আর সেখান থেকে অনুধাবন করেই নিজের মনোভাব প্রকাশ করে চলেছি।
আর আমার এই পর্বের লেখায় তাই লোকজ সংস্কৃতি কিভাবে পরিবেশের রক্ষায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখে চলেছে সেটি বলার চেষ্টা করছি।
বেশ কিছুদিন আগেই গত হলো বিশ্ব পরিবেশ দিবস। আর বর্তমান সময়ে পরিবেশ রক্ষার জন্য বৈশ্বিকভাবে বিভিন্নরকম সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দ্যোগ যেমন নেওয়া হচ্ছে তেমনি বিভিন্ন রকম গবেষণাও করা হচ্ছে যার মাধ্যমে আমাদের বর্তমানে ব্যবহৃত আধুনিক নানা যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য উপাদানের কাঁচামাল কিভাবে প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে নতুনভাবে উদ্ভাবন করা যায় তার চেষ্টা চলছে; সেই সাথে চলছে একই উপাদানকে পুনঃ ব্যবহার করে পরিবেশ দূষণের উপর চাপ কমানোর প্রচেষ্টা।
কিন্তু আমরা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছি আবহমানকাল থেকে চলে আসা আমাদের গ্রাম বাংলার লোক সংস্কৃতি, লোকাচার ও প্রথাগুলোই কিভাবে আমাদের প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে ও প্রকৃতির শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে পরিবেশের রক্ষায় নিরব ভূমিকা পালন করে আসছে?
এখন যদি আমরা আবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে চাই প্রকারান্তরে আমাদের লোকাচার ও প্রথা কিন্তু খুব সহজেই আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পথপ্রদর্শক হতে পারে।
আর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে “লোকজ সংস্কৃতি তখনই পথপ্রদর্শক হতে পারে যখন এই সম্পর্কে আমরা একদম গোড়া থেকে জ্ঞান অর্জন শুরু করব। একদম আমাদের দেশীয় লোকজ সংস্কৃতির শিকড় সম্বন্ধে গবেষণায় নামব।
এই সম্পর্কে পড়াশোনা বা গবেষণায় নামলেই কেবল আমাদের লোক সংস্কৃতির মাঝে কি যে সব গুপ্তধন লুকিয়ে আছে তা খুঁজে বের করা সম্ভব।
আমি তো এখন খুব অবাক হয়েই লক্ষ্য করি যে আমার দেশের সংস্কৃতির সাথে আমি ক্ষেত্রবিশেষে কি সুন্দরভাবে যেন বৈশ্বিক সংস্কৃতির ও মিল খুঁজে পাই!
নাহ, একটুও বাড়িয়ে বলছিনা কিন্তু। তবে এই বিষয়টি আরেকদিনের আলোচ্য বিষয় হিসাবে না হয় তোলা থাক!
এবার প্রসংগে আসি। লোক সংস্কৃতি কিভাবে পরিবেশ রক্ষায় হাজার বছর ধরে প্রভাব বিস্তার করে আসছে সেটা যদি আবেগীয় দিক থেকে বলতে যাই তাহলে হয়ত সবকিছুকেই বিবেচনায় আনতে হবে! সেই হিসাবে হয়ত আমাদের বিভিন্ন হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য পালকি, গরুর গাড়ি, পাল তোলা নৌকা ইত্যাদির নাম করাই যায় যেসব যানবাহনে পরিবেশ দূষণের বালাই নেই!
বর্তমান দ্রুতগতির যুগে হয়ত শৌখিনতার বশে এসবের কিছুটা স্বাদ নেওয়া যায়, তাও সেই শৌখিনতা করার মতো উপায়টাও কি আমরা রেখে যাচ্ছি?
পৃথিবীর অনেক স্থানেই যতই জ্ঞান বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির জোয়ার বয়ে যাক না কেন, কিছু কিছু ঐতিহ্য তারা পূর্বপুরুষের গৌরব ও সংস্কৃতিকে বংশ পরম্পরায় বাঁচিয়ে রাখার জন্যই করে থাকে!
আর আমরা কি করছি?
আমার বরাবর ই একটি আক্ষেপ আমরা পশ্চিমা ধারায় হয়ত অন্যান্য কোন অগ্রগামী দেশ বা সংস্কৃতির (এখানে অগ্রগামী দেশ বলতে পুরোপুরি পশ্চিমা নয় কিংবা অন্যান্য দিকগুলোর সংস্কৃতিকে বুঝাতে চেষ্টা করছি) তুলনায় একটু বেশিই গা ভাসিয়ে দিচ্ছি।
আমাদের লোকজ সংস্কৃতি যে কিভাবে আমাদের আসল শেকড়কে রক্ষা করে চলেছে কিংবা যেকোন প্রকার প্রাকৃতিক কিংবা অপ্রাকৃতিক দুঃসময়েও যে কিভাবে তা কাজে লাগতে পারে তা হয়ত এখন আমি যতটুকু অনুধাবন করতে পারি ততটুকু ভাষায় ও প্রকাশ করতে পারি না।
ভেবে দেখুন তো আমাদের বর্তমানের চলমান বাংগালী এক বিশেষ ঐতিহ্য পহেলা বৈশাখের কথা। যেটাকে আমরা বর্তমানে শুধু একদিনের আবেগ বানিয়ে অনেকটা ভোগবাদী ব্যবসায়ীক সংস্কৃতিতে পরিণত করেছি, সেটি কি আদৌ এরকম ছিলো?
পহেলা বৈশাখে এখন আয়োজন করে গরম ভাতে পানি ঢেলে পান্তা বানিয়ে আর সেই আয়োজনের ব্যবসায়ীক মুনাফা অর্জনে জাটকা ইলিশ মজুদ করে যে মেকি সংস্কৃতি আর বিলাসিতায় রূপ দিয়েছি আদৌ কি তা এমন ছিলো?
এর মূলরূপটা কি কেউ অনুধাবন করতে পারেন? কেউ কেউ হয়ত পারবেন। এখন আমি যদি বলি বাংলার কৃষি প্রধান সমাজে যেখানে নিন্মবিত্ত বা নিন্মমধ্যবিত্তের আধুনিক খাবার সংরক্ষণের যন্ত্র (রেফ্রিজারেটর) ছিলো না তখন তারা আগের দিনের বেঁচে যাওয়া ভাতকে গরমের দিনে নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতেই পানিতে ভিজিয়ে সংরক্ষণ করে পরে তা সকালে পান্তা ভাত হিসাবে খেত।
তার ও অনেক আগে হয়ত ইলিশের প্রাচুর্য এদেশে ছিলো যা আমরা “পদ্মা নদীর মাঝি” উপন্যাসে অনেকখানিই পাই। প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্যই আমাদের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মানুষের আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াই এমন খাবার সংরক্ষণের আয়োজন।
আমরা তো চাইলে বর্তমানে পারতাম এক বা দুই বৈশাখে পান্তা-ইলিশ বর্জন করে আমাদের গর্বের ইলিশকে সংরক্ষণের উদ্দ্যোগ নিতে যাতে একবারের বর্জনের পর আর পরের ক বছর জেলেরা আর অপ্রাপ্তবয়স্ক জাটকা মাছ না ধরে ইলিশের প্রজাতিকে বিলীন করে না দেয়!
তবেই না আমাদের মূল সংস্কৃতির প্রতি আমি ভালোবাসা দেখতাম। আমি বরং পান্তা ইলিশের বদলে পান্তা পেঁয়াজু আর আলু ভর্তায় বিশ্বাসী। আর সাথে যদি থাকে একটা কাঁচা পেঁয়াজ বা কাঁচা মরিচের টুকরা তাহলে তো সোনায় সোহাগা!
আমার মন সব সময় পড়ে থাকে আমি বর্তমানে যেখানে অবস্থান করছি সেই চট্টগ্রাম জেলার বলি খেলার মেলায়! যদিও আমার অন্তর্মুখী স্বভাব আর পরিবারের নানা প্রতিবন্ধকতার দরুণ এই মেলা কচি বয়সে উপভোগ করার মত সৌভাগ্য আমার তেমনভাবে হয়ে ওঠে নি!
তবুও ওই বলিখেলার মেলার বিভিন্ন ঐতিহ্যমন্ডিত জিনিসপত্র যেমন- মাটির বাসন কোসন, কাপ পিরিচ, শৌখিন শো পিচ, বেতের আসবাব, কাগজের ফুল, মাছ ইত্যাদি ই বড় টানে।
মাঝে মাঝে দেখি বর্তমানের প্রচলিত ক্ষতিকর প্লাস্টিকের তুলনায় এসব কত দামী। তবে দামী হলেও তা কিন্তু তুলনামূলকভাবে ব্যবহারে দীর্ঘস্থায়ী আর স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী!
যাই ই হোক, উপরিউক্ত পর্যালোচনার মাঝখানে কেউ আবার আমাকে ব্যবসায়ীক ধ্যানধারণার বিরোধী কিংবা আধুনিক প্রযুক্তির বিপক্ষে অবস্থানরত সেকেলে ও গোঁড়া চিন্তার কেউ বলে ভুল বুঝবেন না!
আমি শুধু এটাই বলতে চাই যে যেসব বিষয়ে আমাদের তথাকথিত আধুনিক প্রযুক্তি যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক তার ব্যবহার কমিয়ে যদি আমাদের লোকজ ধ্যান ধারণার আলোকে প্রকৃতির সম্পদ আহরণ করে প্রকৃতির শিক্ষায় প্রকৃতির কোলে পুনরায় ফিরে যেতে চাই তাতে দোষের কিছু নেই।
কামার কুমারের হাত বা পায়ের পেশিশক্তির সাহায্যে চালিত যন্ত্রের তুলনায় যদি আধুনিক মোটর চালিত যন্ত্র কিছুটা উৎপাদনের গতি বাড়ায় তবে পেশিশক্তির বদলে অবশ্যই তার প্রতিস্থাপন করা যায়।
কিন্তু কুমারের মাটির তৈজস পত্রের আবেদন প্লাস্টিকের মতো সস্তা ও পরিবেশের দূষনকারী উপাদানের কাছে যদি বিলুপ্ত হয়ে যায় তবে তা আমাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য রক্ষা, জীবিকার হুমকি ও এদের মানবেতর জীবন যাপনের কারণ হলে তা কখনোই কাম্য নয়।
নিজ ঐতিহ্যের উপাদান ও সংস্কৃতি যেমন একটি দেশ বা অঞ্চলের জন্য মৌলিক তেমনি এই মৌলিকত্বকে বজায় রেখেও কিন্তু গ্রামাঞ্চলের এসব শিল্পের সাথে জড়িত স্বল্প আয়ের মানুষদের নিয়ে ব্যবসা বানিজ্য করা যায়।
এতে যেমন সকলের মধ্যে দেশের সম্পদের সুষম ব্যবহার সম্ভব হবে তেমনি বেঁচে যেতে পারে আমাদের প্রায় হারিয়ে যেতে বসা লোকজ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর রক্ষা পেতে পারে আমাদের দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
এখানে শুনতে খুবই আবেগীয় মনে হলেও দেশের সকল স্তরের মানুষের সচেতনতায় আমাদের লোকসংস্কৃতিকে রক্ষার তাগিদে পদক্ষেপ নিলে এটি অসম্ভব কিছুই না।
আর প্রকৃতি সবসময় ই তার প্রতি কদরকে প্রতিদানস্বরূপ মানব ও জীববৈচিত্র্যের মাঝে তার দশগুণ ফেরত দিতে জানে। আর বিপরীতভাবে প্রকৃতির স্বাভাবিক ছন্দের পতন মানবজাতি ও জীববৈচিত্রে ডেকে আনে ভয়ংকর পরিণতি ও ভারসাম্যহীনতা!
তাই আসুন সময় থাকতেই আমাদের দেশীয় বিভিন্ন লোকাচার, লোক উপাদান ও সংস্কৃতির প্রতি যত্নবান হই যা পরবর্তী প্রজন্মের রক্ষায় হয়ে উঠবে আশীর্বাদস্বরূপ।
লোকজ সংস্কৃতি রক্ষা হয়ে উঠুক পরিবেশের রক্ষার হাতিয়ার।
আমরা যেন মনে রাখি সেই চিরচেনা প্রবাদ- “সময় গেলে সাধন হবে না।”
আসুন সময় থাকতে সচেতন হই। মানবজাতির উপর প্রকৃতির অভিশাপ কাটাতে প্রকৃতির কাছে নিজেকে সমর্পিত করি।
লেখক- তাসনিম বিনতে সাইফ
সহ সভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটি
লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন।