চাঁদমামা আজ বড্ড একা
বড় হয়েছি আমি
রোজ রাতে আর হয়না কথা
হয়না নেয়া হামি
রোজ রাতে আর চাঁদের বুড়ি
কাটেনা চরকা রোজ
ও বুড়ি, তুই আছিস কেমন
হয়না নেওয়া খোঁজ
কোথায় গেলো সে রুপকথার রাত
হাজার গল্প শোনা
* * * * * * * * * *
সময়টা আজ কেমন যেন
বড় হয়ে গেছি আমি
তারাগুলো আজও মেঘের আড়াল
কোথায় গিয়ে নামি
কেড়ে নিলো কে সেই……
Old School এর এই গানটি শোনেন নি এমন হয়ত খুব কম মানুষকেই খুঁজে পাওয়া যাবে। এই গানটার মতো হয়ত বড় হয়ে ওঠা এই প্রজন্মের যে কেউ তার হারিয়ে ফেলা শৈশবের স্মৃতিকাতরায় ক্লান্ত হয়!
আমার মতো নব্বইয়ের দশকের বাচ্চারা তো আরো গভীরভাবে টের পাবে কি ছিলো সেই দিনগুলি, কেমন হাহাকার জাগে এখন আমাদের বড় হবার এই দিনগুলোতে, যান্ত্রিক শহরের কোন এক অজানা বিষন্নতায়।
নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেওয়া এই আমি এক শহরে বেড়ে ওঠা মানুষ। যান্ত্রিক শহরের রূপ আমার আজন্মকাল ধরে দেখা, অনেক যান্ত্রিক কিছুকেই স্বাভাবিকভাবে চিনে বড় হয়েছি আমি।
তবুও কেন যেন কিছু কিছু সরলতা আমার ভেতর শূন্যতার সৃষ্টি করে রেখেছে আজীবন। এই শূন্যতার কোন অর্থ হয় না কখনোই, দার্শনিকতার ভান করতে গেলেও হয়ত কুল কিনারা পাওয়া যায় না এসবের!
সে যাক গে, আসল কথায় আসি!
প্রশ্ন হইলো, “লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন” আমার কাছে কি আর কেন আমি এই সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে একে গভীরভাবে ভালোবেসে নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় আছি।
ওই যে, যেটা বললাম প্রথমে সেটাই। হতে পারে সেটা ভাবুক দার্শনিকের ভং কিংবা শহরের যান্ত্রিকতায় বিষন্নতার কালো মুখোশ।
মাঝে মাঝে মনে হয় গ্রামে ফিরে যাই, কিংবা কোন মফস্বলে, সবুজে। যেখানে দুদন্ড শান্তি আছে, আকাশ থেকে নেমে আসা স্বর্গীয় শান্তি!
শহরের যান্ত্রিকতা আর জীবিকার তাগিদে ভবিষ্যতের ইঁদুর দৌড়ের কথা ভাবলেই জীবনের অর্থ খুঁজতে বড় ব্যাকুল হই।
কোথায় গেলো আমাদের সেই নব্বইয়ের দশকের ছোটবেলা?
গ্রামে হয়ত ছিলাম না, থাকলে হয়ত পেতাম বৈশাখী মেলা, পালা গান, পটের গান, গম্ভীরা, শীতল পাটি, বেত আর কাপড়ে মোড়ানো হাত পাখা, তালপাতার পাখা, ঢেঁকির ধুম ধুম তালে আছড়ে পড়ার শব্দ, শীতের পিঠা আর খেঁজুরের রস!
এখনো হয়ত খুঁজলে গ্রামেই কিছুটা পাবো এসব!
কিন্তু আমার ছোটবেলায় শহরেও কি কম পেয়েছি? এখনো তো অনেক স্মৃতি। তাছাড়া গ্রাম প্রধান বাংলাদেশে শহরের মানুষগুলার শেকড়টাও যে যেকোন সূত্রে গেঁথে থাকে গ্রামেই!
নিজেও তো শীতে মামাবাড়ি গিয়ে কিছুদিন থাকলেও এসবের ছোঁয়া নিয়েই ফিরে আসি। এখনো গ্রামে কত সরলতা, সবার মধ্যে এক অদৃশ্য আত্মিক বন্ধন।
আমার প্রজন্মেই আমি আমার বাসায় যে শিল পাটা দেখেছি সেটাই কি আর আমার পরের প্রজন্ম দেখতে পাবে? নাকি আমিই আর হরেক রকমের ব্লেন্ডার মেশিনের ভিড়ে কোনদিন শিল পাটা ঘরে তুলব?
হয়ত শিল পাটা আর থাকবে না আমার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, কিন্তু আমি আমার শেকড় আর লোকজ সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন থাকলে হয়ত আমার পরের প্রজন্মকে তাদের দাদী নানীদের শিল পাটার ব্যবহার আর এর ছবি দেখাবো। এসব ইতিহাস আর ঐতিহ্য বিলীন হয়ে গেলে আর কোথায় পাবো এসব নস্টালজিয়া?
ছোটবেলায় যে কলোনীতে থাকতাম সেখানেই যে কত ফেরিওয়ালা আসত! সেই সাথে আসত শিল পাটা কুটে দেওয়া বা ধার করে দেওয়ার জন্য পাটা কুটানি। একসময় তারা পাটা কুটার সময় হাতুড় আর বাটাল দিয়ে সেই পাটায় ই ফুটিয়ে তুলত বিভিন্ন নকশা বা মাছ, ফুল, পাখি। জীবনের প্রতিটি ধারায় ই কি সুন্দর এক শৈল্পিক ছোঁয়া!
দা বটি ধার করার জন্য ও এক ফেরিওয়ালা আসত এক বিশেষ সাইকেল কাঁধে নিয়ে, সেই সাইকেলের সামনে থাকত শান দেওয়ার জন্য পাথর। বিশেষ কায়দায় প্যাডেল মেরে শান দেওয়া হতো দা বটি। কতকাল শুধু মনে হতো তাকিয়েই থাকি আর পাথরের ঘর্ষণে দুইদিকে ছড়িয়ে পড়া ছোট ছোট আলোকদ্যুতির খেলা দেখি!
এসব কি জানবে কখনো আমার পরের প্রজন্ম? নাকি ওরকম এক সরল সিধা জীবন আর এক জীবনে আমি আর ফেরত পাবো?
আমার আসল বাঙ্গালি সংস্কৃতির শেকড়টা আসলে কোথায়? শহরে হয়ত ভাগ্যক্রমে সেই বাচ্চাকালে আমি এসবের ছিঁটে ফোঁটা পেয়েছি৷ বর্তমানে মিডিয়া জগতেও কি বাঙ্গালি সংস্কৃতির কোন অস্তিত্ব আছে? যা কিছু আছে তা তো সবই পশ্চিমা আর ভারতীয় সংস্কৃতির সংকরায়নের মাধ্যমে জগাখিচুরি মার্কা বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন!
মিডিয়ার কথা যখন চলেই আসলো তখন প্রসংগক্রমে নব্বইয়ের দশক নিয়ে যদি আমি শহুরে জীব হিসাবে আরেকটু বড়াই করি তাহলে হয়ত টেলিভিশন নামক জাদুর বাক্সের কথা আসবে কিছু, আর সেই জাদুর বাক্সের প্রধান উৎস ছিলো বিটিভি আর কিছুদিনের জন্য তার সাথে থাকা একুশে টিভি!
একুশে টিভিতে প্রতি ঈদে প্রচারিত হওয়া এনিমেশন “মন্টু মিয়ার অভিযান” কি কারো মনে আছে? আমি কিন্তু দুই দিন আগেই চার পর্ব ইউটিউব থেকে খুঁজে বের করেছি।
শুক্রবারে বিটিভির পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা সিনামা আর উপস্থাপিকার উপস্থাপনে নায়ক নায়িকার নাম ঘোষণার সবশেষে যদি থাকে জাম্বু, তাহলে আর আমাদের খুশি ঠেকায় কে?
জাম্বু, জাম্বু, জাম্বু… নামটা বলতেই তো কত মজা পাই এখনো!
কিংবা রাত ৮টা বা ১০টার সংবাদের পর বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান ইত্যাদি…
এই ইত্যাদি ই তো আধুনিকতার স্রোতে আমরা কিভাবে বাংগালিয়ানা হারিয়ে ফেলছি সেটা কতরকম ঢংয়ে ফুটিয়ে তুলতো।
সেই ইত্যাদিতেই দেখতাম মামা ভাগ্নের নতুন নতুন আইডিয়ার অপপ্রচার, বিদেশিদের প্রাণপণে ভাংগা উচ্চারণে বাংলা বলার চেষ্টা, নানা নাতির তর্ক কিংবা মাঝে মাঝে গানের তালে তালে এক ভিন্ন গ্রামীণ আংগিকে নানা আর নাতির মাথায় মাথাল আর হাতে লাঠি নিয়ে স্নেহাপরায়ন ঝগড়া যা আমার মনে আজো বিশাল দাগ কেটে রয়েছে।
এই মাত্র বছর দেড়েক আগে “লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের” মাধ্যমে জানতে পেরেছি নানা নাতির এই বিশেষ ধরণের স্নেহপরায়ণ ঝগড়া যাকে গানের লয়ে পরিবেশন করার মাধ্যমে সমাজের নানা অসংগতি হাস্যরসের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় আর চমৎকার এই মাধ্যমটির নাম হলো “গম্ভীরা”।
শুধু কি তাই? আরো যে নাম না জানা কত গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির সাথে আস্তে আস্তে পরিচিত হচ্ছি আমি। এতদিন যে শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করছিলাম তা হয়ত আমার শেকড়ের সন্ধানে নিয়োজিত হওয়ার মাধ্যমেই খুঁজে পেতে পারি।
আলকাপ, জারি সারি গান, বিভিন্ন পালা পর্বণ, পটের গান, বন্দনা, পুঁথি পাঠ, যাত্রা কত যে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির মাধ্যম এই আমার গ্রাম বাংলায়!
আধুনিককালের বিজাতীয় সংস্কৃতির মুখোশে মোড়ানো চটকদার বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের মাধ্যমগুলোতে কি আমি আমার অস্তিত্ব খুঁজে পাবো নাকি লোভনীয় সব জাদুর মায়ার ফাঁদে পড়ে অত্যাধুনিক বিষন্নতার অপশক্তিকে জয় করতে পারবো?
আমি আমার সেই সব হারানো সংস্কৃতিগুলোকে সংরক্ষণ করে এর প্রচার প্রচারণা ও অনুশীলনের মাধ্যমে আমার শেকড়ে ফিরে যাবার এক মহান আন্দোলনে ব্রতী হয়েছি আমার সেই ছোট্টবেলার ক্ষুদ্র কিছু আবেগীয় স্মৃতিকে অবলম্বন করে।
আমি হয়ত গ্রামীণ লোক সংস্কৃতির এক বিন্দুও শহুরে জীবনে নিজের অস্তিত্বে গ্রামীন সহজ সরল মানুষগুলোর মতো মতো মনে প্রাণে ধারণ করতে পারি নি।
তবে তবুও জোর গলায় এই কথা নিঃসন্দেহে বলতেই পারি যে, লোকজ সংস্কৃতির এসব উপাদান যেকোন অবস্থায় যেকোন প্রজন্মকেই একটি সুন্দর ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করতে পারে যা অন্য কোন মাধ্যমে কখনোই এভাবে সম্ভব নয়।
একটি সুন্দর, নির্মল ও সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে তাই আমি আমার জায়গা থেকে আমার দেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা এবং হারিয়ে যাওয়া লোকজ সংস্কৃতির রক্ষায় বদ্ধ পরিকর হয়েছি।
আর এক্ষেত্রে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন সন্দেহাতীতভাবে একটি অগ্রগামী ভুমিকা পালন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে!
লেখক: তাসনিম বিনতে সাইফ
সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম জেলা
লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন।