“বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখনও বসে
বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি, ফিকাহ ও হাদিস চষে।”
জাতীয় কবি কথাগুলো বলেছিলেন ভারতবর্ষের, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারকে ইঙ্গিত করে।
আজ থেকে অনেক আগেই সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রিয় কবি এই পঙ্ক্তিগুলো উচ্চারণ করলেও এখনো তা সমভাবে প্রাসঙ্গিক।
তিনি যে বাঙালি মুসলমানদের মনোজগতে আঘাত দিয়ে তাদের চৈতন্যোদয় ঘটাতে চেয়েছিলেন, সেই বাঙালি মুসলমান আমরা এখনো জেদ ও ফতোয়াবাজিতে ব্যস্ত রয়েছি।
তার গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে। সাতাত্তর বছর জীবনের পুরোটা জুড়েই ছিলো সৃষ্টি ও সৃজনশীলতার এক বিশাল ইতিহাস।
দাসত্বের শৃঙ্খলে বদ্ধ জাতিকে শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে মুক্ত হবার ডাক দিয়ে তিনি লিখেছিলেন,
“বল বীর বল উন্নত মম শির,…”
লিখেছেন,
“যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না -বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত!’
বাংলা সাহিত্যে তাঁর মত অসাম্প্রদায়িক কবি খুবই কম দেখা গিয়েছে। তাঁর পরিচয় ছিল মানুষ হিসাবে।
কবি নজরুল ইসলাম সব ধর্মের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তাঁর ‘মানুষ’ কবিতার বিখ্যাত একটি লাইন ছিল –
‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’
পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম আঠারোশো নিরানব্বই সালের আজকের এই দিনটিতে অর্থ্যাৎ চব্বিশে মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
অল্প বয়সে স্থানীয় মসজিদে তিনি মুয়াজ্জিনের কাজ করেছিলেন।
কৈশোরে ভ্রাম্যমাণ নাটক দলের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে সাহিত্য, কবিতা ও নাটকের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। অর্থের অভাবে পড়াশোনা করতে পারেননি। জীবিকার তাগিদে বাল্যকালে খানসামা ও চায়ের দোকানে রুটি বানানোর কাজ করেছেন।
ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন নজরুল ইসলাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সৈনিকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
সেনাবাহিনীর কাজ শেষ করে কলকাতায় ফেরার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন।
প্রকাশিত হয় ‘বিদ্রোহী’ এবং ‘ভাঙার গানের’ মতো কবিতা এবং ধূমকেতুর মতো সাময়িকী।
জাতীয়তবাদী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার জন্য বহুবার কারাবন্দী হয়েছিলেন নজরুল ইসলাম। জেলে বন্দী অবস্থায় লিখেছিলেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’।
তাঁর এইসব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল প্রকট।
সাংবাদিকতার মাধ্যমে এবং পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যকর্মে নজরুল শোষণের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজী নজরুল ইসলামকে বর্ণনা করেছিলেন ‘ছন্দ সরস্বতীর বরপুত্র’ হিসাবে। অনেক বিশ্লেষক বলেন তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তাঁকে অমর করে রেখেছে।
নজরুলের প্রতিভার যে দিকটা ছিল অনন্য সেটা হল তাঁর বিদ্রোহী চেতনার বহি:প্রকাশ- সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি সব কিছুর বিরুদ্ধেই বিদ্রোহে তিনি সোচ্চার হয়েছেন তাঁর সাহিত্যকর্ম ও সঙ্গীতে।
তিনি কিন্তু শুধু কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন গীতিকার, সুরকার, গল্পকার, সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক কর্মীও। কখনও তিনি গান গাইছেন, কখনও পত্রিকা সম্পাদনা করছেন, কখনও রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করছেন।
তাঁর সাহিত্যকর্মেও প্রাধান্য পেয়েছে মানুষের প্রতি তাঁর অসীম ভালবাসা আর মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা নজরুল চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মনে করতেন এর পথে প্রধান বাধা সাম্প্রদায়িক সংঘাত। সেইজন্য তিনি দুর্গম গিরি কান্তার মরু গানে বলেছিলেন
” হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন? কাণ্ডারী বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।”
তিনি গল্প, উপন্যাস, নাটকও রচনা করেছিলেন। বাংলা ভাষায় একটা নতুন প্রাণ নতুন তারুণ্য নিয়ে এসেছিলেন। সৃষ্টি করেছিলেন একটা নিজস্ব ভাষার, যে ভাষার মধ্যে তিনি দেশজ বাংলার সঙ্গে সফলভাবে ঘটিয়েছিলেন বহু আরবি ও ফারসি শব্দের সংমিশ্রণ।
নজরুল প্রায় তিন হাজার গান রচনা করেছিলেন এবং অধিকাংশ গানে নিজেই সুরারোপ করেছিলেন যেগুলো এখন “নজরুল গীতি” নামে বিশেষ জনপ্রিয়।
গজল, রাগপ্রধান, কাব্যগীতি, উদ্দীপক গান, শ্যামাসঙ্গীত, ইসলামী গান বহু বিচিত্রধরনের গান তিনি রচনা করেছেন।
তিনি অত্যান্ত সাবলীলভাবে বাংলার লোকোসঙ্গীতের সংগীতের সঙ্গে রাগসঙ্গীতের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন।
মধ্যবয়সে এক দুরারোগ্য রোগে কবি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। উনিশশো বিয়াল্লিশ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে উনিশশো বাহাত্তর সালে সপরিবারে অসুস্থ নজরুল ইসলাম ঢাকায় চলে যান। উনিশশো ছিয়াত্তর সালের উনত্রিশে অগাস্ট ঢাকার পিজি হাসপাতালে আমাদের জাতীয় কবি মৃত্যুবরণ করেন।
আজ তার জন্মজয়ন্তীতে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সকল সদস্য দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।
তারিখঃ- ২৪/৫/২০২১ ইং।