জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, শিক্ষক হুমায়ূন আহমেদের জন্মবার্ষিকী আজ

হুমায়ূন আহমেদ সকলের পরিচিত জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, শিক্ষক। তিনি উনিশশো আটচল্লিশ সালের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ তেরোই নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জে তাঁর মাতামহের বাড়িতে। তবে তাঁর পৈত্রিক বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুর গ্রাম।

তাঁর পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন তবে বর্তমানে আয়েশা ফয়েজ নামে সকলের নিকট পরিচিত।

ফয়জুর রহমান আহমেদ পুলিশ বিভাগে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং কর্তব্যরত অবস্থায় পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন।

সঙ্গত কারণেই হুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জ্বীবিত ছিলেন। উনিশশো একাত্তর সালে পাকবাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে কিছুদিন আটক করে রাখে এবং দৈহিক নির্যাতন করে।

পারিবারিক পরিমন্ডলে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার অনুকূল আবহে হুমায়ূন আহমেদের শৈশব জীবন অতিবাহিত হয়। তাঁর পিতার সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ ছিল। তিনি সমকালীন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করতেন।

বগুড়ায় অবস্থানকালে দীপ নেভা যার ঘরে শিরোনামে তাঁর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সন্তানদেরও তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চার জন্য উৎসাহ দিতেন।

হুমায়ূনের অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। তিনি মূলত শিশু-কিশোরদের জন্য কল্পবিজ্ঞান গল্প ও কাহিনী রচনা করেন।

তাঁর সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা আহসান হাবীব রম্যলেখক ও কার্টুন ম্যাগাজিন ‘উন্মাদ’-এর সম্পাদক। তাঁদের মা আয়েশা ফয়েজও লেখালেখি করতেন।

ছয় ভাই-বোনের মধ্যে হুমায়ূন ছিলেন সবার বড়।

পিতার সরকারি চাকরির সুবাদে হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সিলেট, জগদ্দল, পঞ্চগড়, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, বগুড়া, কুমিল্লা ও পিরোজপুরে অবস্থান করেন। সিলেট জেলা শহরের কিশোরীমোহন পাঠশালায় তাঁর শিক্ষাজীবনের সূচনা।

উনিশশো পঁয়ষট্টি সালে তিনি বগুড়া জেলা স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন (রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান) উনিশশো সাতষট্টি সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন।

উনিশশো সত্তর সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে বিএসসি (সম্মান) এবং উনিশশো বাহাত্তর সালে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তী পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে উনিশশো বিরাশি সালে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

উনিশশো তেহাত্তর সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে শুরু হয় হুমায়ূন আহমেদের কর্মজীবন। তবে পরের বছর অর্থাৎ উনিশশো চুয়াত্তর সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন।

উনিশশো নব্বই সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি অধ্যাপনা পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং সার্বক্ষণিক সাহিত্যর্চ্চায় মনোনিবেশ করেন। এর পাশাপাশি চলে নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণ।

বাংলা কথাসাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ একজন ব্যতিক্রমী লেখক। রচনার ব্যাপ্তি, বিষয়ের বৈচিত্র্য, চরিত্র নির্মাণ, রচনাশৈলী, সংলাপ প্রভৃতি মিলিয়ে তিনি এক অভিনব ধারা সৃষ্টি করেন, যা একান্তই তাঁর নিজস্ব শৈলী হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধিজাত প্রকাশ ও রসবোধের কারণে তাঁর রচনা সহজেই পাঠকের চিত্ত স্পর্শ করে।

বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের গতানুগতিক ধারাকে অতিক্রম করে হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেন এক স্বতন্ত্র ভুবন। একজন সফল লেখক হিসেবে সাহিত্য-শিল্পের বিভিন্ন শাখায় স্বচ্ছন্দ বিচরণ তাঁকে এনে দেয় বিপুল জনপ্রিয়তা। বহুমাত্রিকতা তাঁর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।

ছাত্রজীবনে লেখা নন্দিত নরকে শিরোনামের নাতিদীর্ঘ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের আবির্ভাব। উনিশশো বাহাত্তর সালে তিনি উপন্যাসটি রচনা করেন এবং সে বছরই উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। নন্দিত নরকে বাংলাদেশের পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়।

তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস শঙ্খনীল কারাগার। গল্প, উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, শিশুতোষ গ্রন্থ, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজৈবনিক রচনা প্রভৃতি মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা তিন শতাধিক। তাঁর শেষ উপন্যাস দেয়াল (অপ্রকাশিত-পটভূমি উনিশশো পঁচাত্তর সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ড ও তৎকালীন রাজনৈতিক ঘটনা)।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা জনপ্রিয় উপন্যাস জোছনা ও জননীর গল্প। হুমায়ূন আহমেদকে বাংলাদেশের সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ বলা যায়। তাঁর অন্যতম সায়েন্স ফিকশন তোমাদের জন্য ভালোবাসা। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস মধ্যাহ্ন এবং বাদশাহ নামদার। আত্মজৈবনিক রচনায়ও তিনি স্বচ্ছন্দ। তাঁর স্মৃতিকথাগুলো সুখপাঠ্য।

বিষয়বস্তুর দিক থেকে হুমায়ূন আহমেদের গ্রন্থসম্ভার কয়েকটি শ্রেণিতে বিন্যাস করা যায়।

যেমন তার রচিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে শ্যামল ছায়া, আগুনের পরশমণি, অনিল বাগচীর একদিন, ১৯৭১, জোছনা ও জননীর গল্প প্রভৃতি।

স্থান-কাল ও বিষয়ভিত্তিক প্রধান গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে শঙ্খনীল কারাগার, আনন্দ বেদনার কাব্য, যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ, আমার আছে জল, ফেরা, নক্ষত্রের রাত, প্রিয়তমেষু, বাসর, এলেবেলে, সাজঘর, ছায়াসঙ্গী, এই সব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, অয়োময়, গৌরীপুর জংশন, শ্রাবণ মেঘের দিন, আশাবরী, অমানুষ, চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক, দুই দুয়ারী, নৃপতি, নী, কোথাও কেউ নেই, মন্দ্রসপ্তক, কবি, মহাপুরুষ, আমাদের সাদা বাড়ি, মেঘ বলেছে যাব, দূরে কোথায়, বৃষ্টিবিলাস, মৃন্ময়ী, হুমায়ূন আহমেদের হাতে ৫টি নীল পদ্ম, বৃষ্টি ও মেঘমালা, আজ চিত্রার বিয়ে, এপিটাফ, লীলাবতী, তিন পুরুষ, মধ্যাহ্ন-১, মধ্যাহ্ন-২, বৃক্ষকথা, বাদশাহ নামদার, মেঘের ওপর বাড়ি প্রভৃতি।

সায়েন্স ফিকশনসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তোমাদের জন্য ভালোবাসা, তারা তিনজন, ইরিনা, কুহক, ফিহা সমীকরণ, শূন্য, ইমা, অনন্ত নক্ষত্র বীথি, ওমেগা পয়েন্ট, দ্বিতীয় মানব প্রভৃতি।

তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে কোয়ান্টাম রসায়ন।

রহস্যধর্মী ও ভূত বিষয়ক গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বোতল ভূত, ভূত ভূতং ভূতৌ, ভয়, একি কান্ড, চেরাগের দৈত্য এবং বাবলু, বোকাভু, কানী ডাইনী, ভূতসমগ্র, মজার ভূত, ভয়ংকর ভূতুড়ে, অতিপ্রাকৃত, নির্বাচিত ভূতের গল্প, ভূতমন্ত্র প্রভৃতি।

শিশু কিশোর গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে নুহাশ এবং আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ, ছোটদের সেরা গল্প, পরীর মেয়ে মেঘবতী, তোমাদের জন্য রূপকথা, কালো জাদুকর, কাক ও কাঠগোলাম, ছোটদের জন্য এক ব্যাগ হুমায়ূন, বোকা রাজার সোনার সিংহাসন, নীল মানুষ, কুহুরানী, হলুদ পরী, বনের রাজা প্রভৃতি।

আত্মজৈবনিক গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে হোটেল গ্রেভারইন, আমার ছেলেবেলা, কিছু শৈশব, বলপয়েন্ট, কাঠপেন্সিল, ফাউন্টেন পেন, রঙ পেন্সিল, নিউইয়র্কের নিলাকাশে ঝকঝকে রোদ।

তার সবচেয়ে বিখ্যাত হিমু সিরিজের মধ্যে রয়েছে ময়ূরাক্ষী, দরজার ওপাশে, হিমু, পারাপার, এবং হিমু, হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম, হিমুর দ্বিতীয় প্রহর, হিমুর রূপালী রাত্রি, একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁঝিঁ পোকা, তোমাদের এই নগরে, সে আসে ধীরে, চলে যায় বসন্তের দিন, হিমু মামা, আঙুল কাটা জগলু, হলুদ হিমু কালো র‌্যাব, আজ হিমুর বিয়ে, হিমু রিমান্ডে, হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য, হিমুর মধ্যদুপুর, হিমুর বাবার কথামালা, হিমুর নীল জোছনা, হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী, হিমুর আছে জল, হিমু এবং হার্ভার্ড পিএইচ.ডি বল্টু ভাই প্রভৃতি।

বিখ্যাত মিসির আলি সিরিজের মধ্যে রয়েছে দেবী, অন্যভুবন, বিপদ, মিসির আলির অমীমাংসিত রহস্য, তন্দ্রাবিলাস, আমিই মিসির আলি, বাঘবন্দি মিসির আলি, নিশীথিনী, নিষাদ, বৃহন্নলা, কহেন কবি কালিদাস, মিসির আলির চশমা প্রভৃতি।

তার শুভ্র সিরিজের মধ্যে রয়েছে দারুচিনি দ্বীপ, রূপালী দ্বীপ, শুভ্র, এই শুভ্র ! এই, শুভ্র গেছে বনে প্রভৃতি।

আশির দশকে বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটক ও ধারাবাহিক নাটকের ইতিহাসে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেন।

হুমায়ূনের প্রথম টেলিভিশন নাটক ছিলো প্রথম প্রহর। তাঁর প্রথম ধারাবাহিক নাটক এইসব দিনরাত্রি বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়।

এ ছাড়া অন্যান্য জনপ্রিয় ধারাবাহিকের মধ্যে আছে: বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, নক্ষত্রের রাত এবং অসংখ্য একক ও ধারাবাহিক নাটক।

হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্র নির্মাণেও সার্থক। তাঁর প্রথম ছবি আগুনের পরশমণি এবং শেষ ছবি ঘেটুপুত্র কমলা।

তাঁর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র শ্যামল ছায়া উনিশশো একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি অবলম্বনে নির্মিত। এটি ‘অস্কার একাডেমী পুরস্কার’-এর জন্য ‘সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র’ বিভাগে বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নির্বাচিত হয়।

অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত এবং আমার আছে জল।

পঁচাশিতম অস্কার বাংলাদেশ কমিটি পঁচাশিতম একাডেমী অ্যাওয়ার্ড (অস্কার) প্রতিযোগিতার জন্য ঘেটুপুত্র কমলা ছবিটি মনোনীত করে।

সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ মধ্যবিত্ত দর্শকদের হলমুখী করে তোলেন।

তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয় কয়েকটি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত দূরত্ব, সুভাষ দত্ত পরিচালিত আবদার, বেলাল আহমেদ পরিচালিত নন্দিত নরকে, আবু সাইদ পরিচালিত নিরন্তর, শাহ আলম কিরণ পরিচালিত সাজঘর এবং তৌকির আহমেদ নির্মিত দারুচিনি দ্বীপ ।

বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার গল্প হুমায়ূন আহমেদ তুলে ধরেন সহজ সাবলীল ও হূদয়গ্রাহী ভাষায়।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প উপন্যাসে তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বেদনা প্রবলভাবে ফুটে ওঠেছে, যা সমগ্র জাতির দুঃখ, বেদনা ও সংগ্রামের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখকের বর্ণনার কৌশলে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। তাঁর শিশুতোষ রচনা নির্মল আনন্দের পরিবেশ তৈরি করে। ভূতের গল্পগুলো আকর্ষণীয় এবং রোমাঞ্চকর।

কোথাও কেউ নেই নাটকের ’বাকের ভাই’ চরিত্রটি প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে । একটি নাটক ও তার চরিত্র কতটা বস্ত্তনিষ্ঠ ও জীবনধর্মী হলে দর্শক এ ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে, তা একমাত্র হুমায়ূন আহমেদের নাটকেই প্রতীয়মান হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের লোকায়ত জীবন ও লোকজ সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল গভীর। এই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে তাঁর গল্প-উপন্যাস-নাটকের বিষয়বস্ত্ত, আবহ ও চরিত্র নির্মাণে। নেত্রকোনা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের সমাজজীবনের প্রেক্ষাপট নানাভাবে এসেছে তাঁর রচনায়।

সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল জমিদার চরিত্র তাঁর অধিকাংশ নাটকের প্রধান কুশীলব হয়ে ওঠে। ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষা বিশেষ ব্যঞ্জনা পায় তাঁর নাটকে। এ ছাড়া তাঁর মনোজগতে অধ্যাত্মচেতনাও প্রবল ছিল। এ কারণেই হয়ত তাঁর রচনায় বাউল, ফকির ও সাধক শ্রেণির মানুষের বিচরণ লক্ষণীয়।

কাহিনী বলার ধরন, বিষয়ের বৈচিত্র্য, বর্ণনায় পরিমিতিবোধ, নাটকীয় চমক সৃষ্টি, ভিন্নধর্মী চরিত্র নির্মাণ, প্রাঞ্জল ভাষা প্রয়োগ হুমায়ূন আহমেদের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। সংলাপ রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ও কালজয়ী। তিনি নিজের মতো করে সাহিত্যের ভাষা ও সংলাপ তৈরি করেন, যা পাঠককে আকৃষ্ট করে।

হুমায়ূন আহমেদের বহুমাত্রিক সৃজনকর্মের মধ্যে সঙ্গীত একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। তিনি কেবল নিজের নাটক ও চলচ্চিত্রের জন্য গান রচনা করেছেন। স্বল্পসংখ্যক গান রচনা করলেও এসব গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং অ্যালবাম আকারে প্রকাশিত হয়।

উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে মরিলে কান্দিস না আমার দায়, আমি আজ ভেজাব চোখ সমুদ্রের জলে, চাঁদনি পসর রাতে যেন আমার মরণ হয়, আমার আছে জল, মনে বড় আশা ছিল প্রভৃতি।

রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে আরম্ভ করে হাছন রাজা, লালন শাহ ও অন্যান্য লোকশিল্পীর গান এমনকি লোকশিল্পীকে তিনি অনায়াসে ব্যবহার করেছেন তাঁর নাটকে।

সৃজনশীলতার স্বীকৃতিস্বরূপ হুমায়ূন আহমেদ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে লেখক শিবির পুরস্কার, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কার, হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার , জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একুশে পদক, শেলটেক পুরস্কার।

বাংলাদেশের বাইরেও তিনি সম্মাননা পেয়েছেন। জাপান টেলিভিশন NHK তাঁকে নিয়ে পনের মিনিটের একটি প্রামান্যচিত্র প্রচার করে Who is who in Asia শিরোনামে।

লেখক হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বিশাল পাঠকসমাজ তৈরি এবং তরুণ প্রজন্মকে বই পাঠে আগ্রহী করে তোলা। বছর বছর তাঁর রচনার কলেবর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়।

তাঁর রচনার পাঠকদের অধিকাংশই তরুণ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সর্বস্তরের মানুষ। একসময় পশ্চিমবঙ্গের গল্প-উপন্যাসের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো এদেশের পাঠকদের।

সেই পাঠকশ্রেণিকে হুমায়ূন আহমেদ গৃহমুখী অর্থাৎ দেশমুখী করে তোলেন তাঁর যাদুকরি সাহিত্যসম্ভার দিয়ে। সাহিত্য-শিল্পের একটি মুখ্য উদ্দেশ্য মানুষকে বিনোদন ও আনন্দ দেওয়া। এ কাজটি তিনি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেন।

উনিশ শতকের সমকালীন পটভূমিতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। জনপ্রিয়তার দিক থেকে হুমায়ূন আহমেদ শরৎচন্দ্রকে ছাড়িয়ে যান। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য-সমালোচক এবং পাঠকদের কাছেও তিনি শক্তিমান লেখক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।

বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের অগ্রগতির ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের অবদান অতুলনীয়। এদেশের সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পকে ম্রিয়মাণ অবস্থা থেকে গতিশীল পর্যায়ে নিয়ে আসেন তিনি। তিনি এককভাবেই বইয়ের বাজার তৈরি এবং প্রকাশনা শিল্পে পুঁজির প্রবাহ সৃষ্টি করেন। তাঁর সৃষ্টিশীল লেখার কল্যাণে বাংলাবাজারের অসংখ্য পুস্তক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হয়।

প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে আয়োজিত বাংলা একাডেমীর বইমেলায় বিক্রি হওয়া সৃজনশীল গ্রন্থের একটি বড় অংশ হুমায়ুন আহমেদের। তিনি ছিলেন বাংলা একাডেমীর বইমেলার প্রধান আকর্ষণ।

সাহিত্য জগতের সংকীর্ণ দলাদলি বা রাজনীতির সঙ্গে হুমায়ূন কখনো জড়িত হননি। তবে দেশ ও জাতির সমস্যার ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন না। তাই দেশের যে কোনো সংকটময় মূহুর্তে তিনি সুচিন্তিত মতামত ও বক্তব্য প্রকাশ করতেন। নিজের সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পিতৃভূমি নেত্রকোনায় তিনি একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এ স্কুল নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিল, যা জীবদ্দশায় পূরণ করে যেতে পারেননি।

নিসর্গ প্রেমিক হুমায়ূন আহমেদ নাগরিক জীবনের কোলাহল থেকে দূরে প্রকৃতির কোলে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন।

তাই গাজীপুরের পিরুজালি গ্রামে স্থাপন করেন নুহাশ পল্লী এবং সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে সমুদ্র বিলাস নামে বাড়ি। নুহাশ পল্লীকে সাজিয়েছেন নয়নাভিরাম বৃক্ষ, দিঘি ও ভাস্কর্য দিয়ে। প্রায় দু’শ প্রজাতির ঔষধি গাছ রোপন করে নির্মাণ করেন একটি উদ্যান এবং তাঁর অকাল প্রয়াত সন্তানের নামে তার নামকরণ করেন ‘রাশেদ হুমায়ূন ঔষধি উদ্যান’।

দুইহাজার বারো সালের উনিশে জুলাই নিউইয়র্কে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাকে গাজীপুরের নুহাশ পল্লীতে সমাহিত করা হয়।

আজ তার জন্মবার্ষিকীতে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।

তারিখ- ১৩/১১/২০২১ ইং।

Facebook Comments