জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুপ্রিয়া চৌধুরীর জন্মবার্ষিকী আজ

প্রবল বেঁচে থাকার তাড়না নিয়ে দাদাকে চিৎকার করে নীতা বলেছিল, “দাদা, আমি বাঁচতে চাই দাদা।” পাহাড়ে প্রতিধ্বনি হয়ে বারবার ফিরে আসছিল বোনের সেই আকুতি। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যে সংলাপ অমর হয়ে আছে।

বলছি ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত বিখ্যাত বাংলা চলচ্চিত্র মেঘে ঢাকা তারার কথা। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার,উনিশশো ষাট সালের চৌদ্দই এপ্রিল মুক্তি পেয়েছিল চলচ্চিত্রটি।

বাংলার এক গরিব মেয়ে নীতার একা লড়াইয়ের গল্প। জানালা দিয়ে আলো, জলে প্রতিফলিত হয়ে নীতার মুখে পড়ছে, অসম্ভব সুন্দর একটি আবহ সঙ্গীত। সে দৃশ্য ভুলবার নয়। দুর্গারূপী নীতা পরিবারের সকলের বোঝা কাঁধে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে সকলকে এবং নিজেই হয়ে যায় পরিবারের বোঝা। বিংশ শতকের পাঁচের দশকে কলকাতার এক বাঙালি পরিবার ঘিরে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ কাহিনির আবর্তন। সাতচল্লিশ এর দেশভাগের পর এই শরণার্থী পরিবার আশ্রয় নেয় কলকাতা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। ছবির মূল চরিত্র নীতা, পরিবারের বড়ো মেয়ে। পড়াশোনার পাঠ চুকানোর আগেই পরিবারের হাল ধরতে হয় তাকে। নীতার বৃদ্ধ বাবা স্কুলে পড়ায়, মা ঘরবাড়ি দেখাশোনা করে। নীতার চূড়ান্ত অসুস্থতা নজরে পড়ে তার দাদার। পাহাড়ের ওপর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় নীতাকে। জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে এসে, শংকরকে (দাদাকে) জানায়, সে বাঁচতে চায়। আকাশে, পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনি হয় নীতার আকুতি। সুপ্রিয়া হয়ে উঠলেন জীবন্ত নীতা।

চরিত্রটির কথা বলতে গেলে বলতে হয় নীতারা কোনোদিন মরে না, সাধারণ মানুষের মাঝে অসাধারণত্বের পরিচয় দিয়ে তারা যুগ যুগ ধরে বেঁচে থেকে যায় মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে। যতদিন মানুষের স্বার্থের চরিতার্থতা, বিসর্জিত মূল্যবোধ, এবং ভালোবাসার বিপণন মনুষ্যত্বকে করবে কালিমালিপ্ত, ততদিন সেই আঁধারিত অমানিশার মাঝে অগ্নিশলাকার মতোই আবির্ভাব হবে এক নীতার। তাই তার বিরহের দুঃখটা সাময়িক, কিন্তু প্রতীক্ষা চিরন্তন।

নীতার চরিত্রে সুপ্রিয়া দেবীর অসাধারণ অভিনয় সর্বোপরি ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় এই ছবি বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার একটি মাইলস্টোন। এই ছবিতেই সনতের মুখে ঋত্বিক ঘটক বলেছেন, “আদর্শ বলে একটা বস্তু হয়, যার জন্য মানুষকে সাফার করতে হয়।” তাঁর জীবনে ব্যাবসায়িক দিক দিয়ে সর্বাধিক সাফল্যও এনে দিয়েছিল এই সিনেমা।

আর নীতা চরিত্রটিকে প্রাণদানকারী সুপ্রিয়া চৌধুরী তাঁকে বর্ণনা করা হতো ভারতের ‘সোফিয়া লরেন’ বলে। দারুন আকর্ষণীয় চেহারা এবং সেই সঙ্গে চমৎকার অভিনয় দিয়ে তিনি ভারতীয় বাংলা ছবিতে রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন ষাটের দশকে।

সুপ্রিয়া চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন উনিশশো তেত্রিশ সালের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ আটই জানুয়ারী। তিনি ছিলেন পাঁচ দশক ধরে বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে নামকরা তারকারদের একজন। উত্তম-সুচিত্রা জুটির মতোই উত্তম-সুপ্রিয়া জুটিও সেই সাদাকালো যুগের বাংলা ছবির দর্শকদের মধ্যে তুমুল আলোড়ন তুলেছিল।

রূপালি পর্দার বাইরে এই দুই তারকার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়েও অনেক আলোচনা ছিল সেসময়। সুপ্রিয়া চৌধুরি তাদের সম্পর্ককে অবশ্য ‘বন্ধুত্ব’ বলেই বর্ণনা করেছেন।

অসংখ্য ব্যবসাসফল বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি বলিউডের ছবিতে তিনি কাজ করেছিলেন। বলিউডে তার প্রথম কাজ করার সুযোগ হয় ধর্মেন্দ্রর বিপরীতে ‘বেগানা’ ছবিতে।

ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’ এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ সন্মাননা ‘বঙ্গ বিভূষণ’ সহ জীবনে আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন সুপ্রিয়া চৌধুরি।

দুইহাজার আঠারো সালের ছাব্বিশে জানুয়ারি বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার জন্মবার্ষিকীতে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন এর সকল স্তরের সদস্য দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে প্রিয় অভিনেত্রীকে জানাচ্ছি অজস্র ভালোবাসা এবং বিনম্র শ্রদ্ধা।

তারিখঃ- ৮/১/২০২১ ইং।

Facebook Comments