কুতুবদিয়া থানার শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী “সঙপালা” উপস্থাপন করলো লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন।

চারদিকে সমুদ্রের নোনাজল আর মাঝখানে সবুজের সমারোহ। তীরে আছড়ে পড়ে ছোট ছোট ঢেউ, বালির উপর ছড়ানো ছিটানো ঝিনুক, মাঝেমাঝে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে লাল কাঁকড়া। সমুদ্রের দিক থেকে স্নিগ্ধ বাতাস বয়ে এসে দুলিয়ে দেয় পাশের ঝাউবন। নৈসর্গিক এই দ্বীপটির নাম কুতুবদিয়া। ২১৬বর্গ কিলোমিটার এই দ্বীপটির সৌন্দর্য বর্ণনা করে শেষ করা যাবেনা। কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা হচ্ছে এই কুতুবদিয়া। গত ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৬ইং শনিবার ছিল কুতুবদিয়া থানার শতবার্ষিকী। দিনটিকে ঘিরে পুরো দ্বীপটি সেজেছিল অপরূপ সাজে। জাতীয় সংগীত, র‍্যালি, আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করেছিল উপজেলা প্রশাসন। অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
অনুষ্ঠানটি আরো মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের পরিবেশনায়। গ্রামবাংলার লোকজ আঙ্গিকের প্রতি কুতুবদিয়াবাসীর ভালোবাসা দেখে আমরা সেদিন আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম।
৩০শে ডিসেম্বর প্রোগ্রাম থাকলেও আমরা লোকজ পরিবার রওয়ানা করেছিলাম ২৮শে ডিসেম্বর। উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব সুজন চৌধুরী স্যার নিজ তত্ত্ববধানে গাড়ী পাঠিয়ে আমাদেরকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়ে গেলেন। এই গাড়ীটি গিয়ে থামলো কুতুবদিয়া চ্যানেলের কাছে। সেখান থেকে বোটে করে আমরা চ্যানেলটি পার হলাম। কুতুবদিয়া দ্বীপে পা রেখে দেখলাম সেখানে আমাদের জন্য আরো দুটি গাড়ী অপেক্ষা করছে। আমরা গাড়ীতে উঠে বসলাম, গাড়ী দুটি আমাদেরকে নিয়ে কুতুবদিয়া থানায় পৌছুলো। গাড়ী থেকে নেমে ইউএনও স্যার, ওসি স্যার এবং উনাদের ফ্যামিলির কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা এবং ভালোবাসা পেলাম। চা পান করতে করতে আমাদের সার্বিক খোঁজখবর নিলেন ইউএনও সুজন চৌধুরী স্যার। ওখান থেকে বিদায় নিয়ে আমরা পৌছুলাম কুতুবদিয়ার বিলাসবহুল হোটেল সমুদ্র বিলাসে।হোটেল থেকে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেয়ে চলে গেলাম সমুদ্রতটে। ঢেউগুলো পায়ে এসে লাগার সাথে সাথে ভুলে গেলাম দীর্ঘ ৪ঘণ্টা ভ্রমণের ক্লান্তি। প্রায় দেড়টা পর্যন্ত সমুদ্রের নোনা বাতাস গায়ে মেখে ফিরে এলাম হোটেলে তারপর হারিয়ে গেলাম ঘুমের দেশে। সকালের সূর্যটা যখন পূর্বাকাশ আলোকিত করে উদিত হলো তখন দ্বীপের শ্রী আরো বেশি প্রকাশিত হলো। ঘুম থেকে উঠে আমরা নাস্তা সেরে নিলাম। তারপর চলে গেলাম কুতুবদিয়া আদর্শ স্কুলে, গিয়ে দেখলাম ঐ স্কুলের বেশ কয়েকজন ছাত্র আগেই সেখানে উপস্থিত আছে। তারা আমাদের অপেক্ষাতেই ছিল, আমরা পৌঁছানোর পর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা আমাদের রিহার্সালের জন্য টুল টেবিল দিয়ে একটা মঞ্চ তৈরি করে ফেললো। তারপর টানা রিহার্সাল। এর মধ্যে ইউএনও স্যার আর ওসি স্যার খোঁজখবর নিলেন। যেকোনো প্রয়োজনে আমাদের সাথে আছেন সে কথাও জানালেন।
অনুষ্ঠানের দিন সকালের নাস্তা করলাম ইউএনও স্যারের বাসায় এবং দুপুরের খাবার খেলাম কুতুবদিয়া থানায়। ওসি স্যার নিজ হাতে আমাদেরকে আপ্যায়ন করালেন।
রাত ৯টা নাগাদ আমরা লোকজ আঙ্গিক সঙপালা “লটারি” যার রচয়িতা ছিলেন আমাদের লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সম্মানিত সভাপতি Abdullah Al Maruf ভাইয়া,পরিবেশন করার জন্য স্টেজে উঠলাম। চারদিকে হাজার হাজার দর্শক, আমাদের নাটকের প্রতিটি চরিত্রকে তারা দারুণ ভাবে উপভোগ করছিল। মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে আমাদেরকে অভিবাদন জানাচ্ছিল। নাটক শেষে যখন স্থান ত্যাগ করছিলাম তখন দর্শকরা আমাদের একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য ভিড় জমালো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দর্শকের ভিড় ঠেলে আমাদের জন্য পথ তৈরি করে দিলেন। সফলতার তৃপ্তি নিয়ে আমরা হোটেলে ফিরলাম খাওয়াদাওয়া সেরে আবারো চলে গেলাম আমাদের সকলের প্রিয় সমুদ্রতীরে, নোনা বাতাসে শীতল হয়ে এসে যার যার মত ঘুমিয়ে গেলাম।
পরদিন সকালে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতি আবদুল্লাহ আল মারুফের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক রায়হান সুমনের সঞ্চালনায় কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব সুজন চৌধুরী স্যারকে প্রধান অতিথি করে স্থানীয় কিছু সংস্কৃতিমনা ছাত্রদের সাথে নিয়ে লোকজ পরিবারের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন বান্দরবন জেলার প্রধান ম্যাজিস্ট্রেট জনাবা মনিষা মহাজন, কুতুবদিয়া উপজেলা প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকগণ।
সভায় আমন্ত্রিত মেহমানগণ লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সবশেষে ইউএনও জনাব সুজন চৌধুরী স্যার কিছু দিকনির্দেশনামূলক আলোচনা রাখেন। তিনি লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের যেকোনো কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন এবং কুতুবদিয়া উপজেলায় লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের একটি শাখা খোলার আহ্বান জানান।
সভা শেষে আমাদেরকে পুরো কুতুবদিয়া ঘুরে দেখার ব্যবস্থা করে দেন। আমরা পুরো দল কুতুবদিয়ার বিখ্যাত স্থান সমূহ যেমন: বাতিঘর, বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র, কুতুব আউলিয়ার মাজার, লবন চাষ ইত্যাদি ভ্রমণ করে রাত ৮টা নাগাদ হোটেলে ফিরলাম। সেদিন ছিল ২০১৭ইং সনের শেষদিন অর্থাৎ থার্টি ফাস্ট। ২০১৮সাল কে বরণ করার জন্যে ইউএনও স্যার আমাদেরকে অফিসার্স ক্লাবে আমন্ত্রণ জানালেন। আমরা ১০টা নাগাদ ওখানে উপস্থিত হয়ে রাতের খাবার খেয়ে নেই। রাত যখন ১২টা ০১মিনিট তখন আমরা সকলে ফানুস উড়িয়ে বিগত বছরের সকল গ্লানি ভুলে নতুন বছরকে বরণ করে নেই এবং নব উদ্যমে কাজ করার প্রত্যয় গ্রহণ করি।
ঐ রাতটি ছিল আমাদের শেষ রাত। ভোর হতেই রওয়ানা দিতে হবে তাই রাতেই সব গুছিয়ে নিলাম। ভোর ৫টায় আমাদের জন্য গাড়ী এসে উপস্থিত হলো। আমরা খুব নীরবে গাড়ী উঠলাম। সমস্ত কুতুবদিয়াকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে চলে এলাম কুতুবদিয়া ছেড়ে। ফিরে আসার সময় বারবার তাকাচ্ছিলাম কুতুবদিয়ার দিকে। শুনেছি ভালোবাসার মায়া বড় মায়া। ফিরে আসার সময় আমরা সবাই তা অনুভব করলাম। আমরা আরো অনুভব করলাম যে কুতুবদিয়াবাসী আমাদের সকলের মনে একটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। কয়েকজন কে দেখলাম চোখের কোণের জল মুছতে। আমি তখন তাকিয়েছিলাম অথৈ সমুদ্রের পানে। কে যেন জিজ্ঞাসা করলো খারাপ লাগছেনা? বললাম, “চলে যাওয়ার সময় পিছু ফিরতে নেই।”

ভালো থাকুক কুতুবদিয়াবাসী, ভালো থাকুন কুতুবদিয়ার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রনায়ক ইউএনও Sujan Chowdhury স্যার, ওসি দিদারুল ফেরদৌস স্যার, ভালো থাকুক সমুদ্র। আমরা বারবার আসবো এই সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে।

লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের জয় হোক।

লেখক: Raihan Sumon
সাধারণ সম্পাদক
লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন।

লেখকঃ-
আব্দুল্লাহ আল মারুফ
(প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন)

Facebook Comments