কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,

সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।

আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে,

আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।

ভাইবোন সকলেরে যেন ভালোবাসি,

এক সাথে থাকি যেন সবে মিলেমিশি।

ভালো ছেলেদের সাথে মিশে করি খেলা,

পাঠের সময় যেন নাহি করি হেলা।

সুখী যেন নাহি হই আর কারো দুখে,

মিছে কথা কভু যেন নাহি আসে মুখে।

সাবধানে যেন লোভ সামলিয়ে থাকি,

কিছুতে কাহারে যেন নাহি দিঈ ফাঁকি।

ঝগড়া না করি যেন কভু কারো সনে,

সকালে উঠিয়া এই বলি মনে মনে।

 

কবিতাঃ- আমার পণ

[মদনমোহন তর্কালঙ্কার]

 

মদনমোহন তর্কালঙ্কার ছিলেন কবি, সমাজসেবক। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বিল্বগ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক উপাধি ‘চট্টোপাধ্যায়’ হলেও প্রাপ্ত উপাধি ‘তর্কালঙ্কার’ হিসেবেই তিনি সুপরিচিত।

 

তিনি সংস্কৃত ভাষায় রচিত বেশ কয়েকখানি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। সেগুলির মধ্যে সংবাদতত্ত্বকৌমুদী, চিন্তামণিদীধিতি, বেদান্তপরিভাষা, কাদম্বরী, কুমারসম্ভব ও মেঘদূত প্রধান।

 

কবি-প্রতিভার জন্য সংস্কৃত কলেজ থেকে তিনি ‘কাব্যরত্নাকর’ এবং পান্ডিত্যের জন্য ‘তর্কালঙ্কার’ উপাধি লাভ করেছিলেন।

নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে আঠারোশো উনত্রিশ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন এবং সেখানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর সতীর্থ ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। উভয়েই পন্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ও প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশের নিকট সাহিত্য, ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র, জ্যোতিষ ও স্মৃতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।

 

তিনি হিন্দু ল কমিটি থেকে জজ-পন্ডিতের সার্টিফিকেট লাভ করেন আঠারোশো একচল্লিশ সালে। মদনমোহন শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ করে একে একে হিন্দু কলেজ পাঠশালা, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ, কৃষ্ণনগর কলেজ ও সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করেন। শেষজীবনে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মদনমোহন বিদ্যাসাগরের সহযোগিতায় ‘সংস্কৃত-যন্ত্র’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। সেখান থেকে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যটি সর্বপ্রথম গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় সহযোগিতা দান করেন।

 

শুধু তাই নয়, নিজ কন্যা ভুবনমালা ও কুন্দমালাকে তিনি ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হিন্দু ফিমেল স্কুলে প্রেরণ করেন এবং নিজে বিনা বেতনে ওই স্কুলে বালিকাদের পাঠদান করতেন।

 

ওই সময় ভারতে মেয়েদের প্রকাশ্যে শিক্ষার সুযোগ ছিল না; সমাজ তা ভাল চোখে দেখতও না। মদনমোহন নিজেও মুর্শিদাবাদ ও কান্দিতে বালিকা বিদ্যালয়, ইংরেজি বিদ্যালয়, অনাথ আশ্রম, দাতব্য চিকিৎসালয় ইত্যাদি জনহিতকর প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। স্ত্রীশিক্ষার সমর্থনে তিনি সর্বশুভকরী পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় দৃষ্টান্তস্থাপনকারী একটি প্রবন্ধ রচনা করেন।

 

রসতরঙ্গিণী ও বাসবদত্তা মদনমোহনের মৌলিক কাব্যগ্রন্থ। তিন খন্ডে প্রকাশিত তাঁর শিশু শিক্ষা শিশুদের উপযোগী একটি অনন্যসাধারণ গ্রন্থ; ‘পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল’ শিশুপাঠ্য এই বিখ্যাত কবিতাটি তাঁরই রচনা।

 

আঠারোশো আটান্ন সালের আজকের এই দিনে অর্থাৎ ৯ মার্চ কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন এর সকল সদস্য দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে প্রিয় কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই অজস্র ভালোবাসা এবং বিনম্র শ্রদ্ধা।

তারিখ:- ০৮/০৩/২০২১ ইংরেজি

Facebook Comments