নিজেকে সবসময়ই “এক্কেবারে বাংলাদেশের পোলা” বলে পরিচয় দিতেই সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি। কলকাতায় বসে তার শিল্পের সব উত্তরণ ঘটালেও বাংলাদেশের দর্শক-শ্রোতার কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘ঢাকার ভানু’।
বলছি উপমহাদেশের বাঙালি কমেডি কিং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা।
জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের ঢাকার বিক্রমপুরের পাঁচগাঁওয়ে আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে উনিশশো বিশ সালের ছাব্বিশ আগস্ট। তাঁর আসল নাম সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। আর ডাকনাম ছিল ভানু।
পরবর্তীকালে সাম্যময় থেকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নামেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। অডিও ক্যাসেটে রেকর্ডকৃত কৌতুক প্রবল জনপ্রিয় হওয়ায় তিনি হয়ে ওঠেন ঢাকার ভানু। বাবা জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। মা সুনীতি দেবী। জিতেন্দ্রনাথের ছাত্র ছিলেন পরবর্তীকালের দুই বিখ্যাত অভিনেতা শিশির কুমার ভাদুড়ি ও অহীন্দ্র চৌধুরী।
মুন্সিগঞ্জের কাজি পাগলা এ.টি. ইনস্টিটিউট থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ঢাকার পোগোজ স্কুল ও সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরে জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য ঢাকা শহর ত্যাগের পরোয়ানা জারি হয়। তারপরই সাম্যময় ঢাকা ছেড়ে চলে যান কলকাতায়। কলকাতায় চারু এভিনিউতে থাকতেন তিনি। কলকাতায় বিভিন্ন অফিস ও ক্লাবের অনুষ্ঠানে কৌতুক নকশা পরিবেশন করে রীতিমতো জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেই জনপ্রিয়তা একসময় এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছে যে, তিনি উনিশশো তেতাল্লিশ সালে ‘ঢাকার গাড়োয়ান’ নামে একটি কৌতুক নকশার রেকর্ড বের করেন।
তবে তিনি কোনোদিনই ভাবেননি যে তিনি একজন চলচ্চিত্রে অভিনেতা হবেন। বরং মঞ্চে অভিনয়ের দিকেই তার ঝোঁক ছিল সবচেয়ে বেশি।
উনিশশো ছেচল্লিশ সালে ভানু বিয়ে করেন বেতার শিল্পী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বিয়ের তিন দিন পরই প্রথম ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পান ভানু। ছবির নাম ছিল ‘জাগরণ’।
তবে সিনেমার জগতে ভানুর প্রথম বাণিজ্যিক সফল ছবি নির্মল বসুর ‘সাড়ে চুয়াত্তর’।
এই ছবিটি বাংলা কমেডি সিনেমার ইতিহাসে একটি অন্যতম মাইলস্টোন। এক ছবিতেই বাজিমাত করেন ভানু। বাংলার দর্শক-শ্রোতা তাঁকে বলতে থাকেন কমেডি কিং।
তিনি অভিনয় করেছেন অন্তত তিনশো ছবিতে। আর প্রায় ছবিতেই তাঁকে তৈরি করতে হয়েছে কৌতুক। সংলাপ থেকে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে নিজেই গড়ে নিয়েছিলেন কমেডির নিজস্ব ভুবন।
ক্যারিয়ারের শেষ দিকে যুক্ত হয়েছিলেন যাত্রাপালায়। ভানুর উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালার মধ্যে ছিল গোপাল ভাঁড়, বৈকুণ্ঠের উইল, শ্রীযুক্ত আলিবাবা ইত্যাদি।
তাঁর সম্পদ ছিল তাঁর মুখের ভাষা। ভানু তাঁর কৌতুকে নানা সময়ে সমাজের নানা বিষয় নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। বাঙালি দাম্পত্য নিয়েও রয়েছে ভানুর নানা অকাট্য মন্তব্য। যেমন, বাঙালি কর্তাদের গিন্নির কাছে চল্লিশ মিনিট ধরে চা চাইলেও নাকি শুনতে হয় পাঁচ মিনিটের মধ্যে দিচ্ছি।
উনিশশো তিরাশি সালের আজকের এই দিনে অর্থাৎ চৌঠা মার্চ তিনি মাত্র বাষট্টি বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। “লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন” এর সকল সদস্য, দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে প্রিয় এই অভিনেতার মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই অজস্র ভালোবাসা এবং বিনম্র শ্রদ্ধা।
তারিখ:- ০৪/০৩/২০২১