বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ধারায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম বিশেষ ভাবে স্মরণীয়।বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক তথা জনপ্রিয় গল্পকার হিসাবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম সোনার অক্ষরে লেখা আছে। গল্প রচনায় প্রাণবন্ততা ও সাবলীল ভাষায় সেই সময়ের পল্লীসমাজকে গল্পে জীবন্ত করার কারণেই শরৎচন্দ্রের উপন্যাস এত জনপ্রিয়।
তিনি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় এবং বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। তার অনেক উপন্যাস ভারতবর্ষের প্রধান ভাষাগুলোতে অনূদিত হয়েছে। বড়দিদি, পল্লীসমাজ, দেবদাস, চরিত্রহীন, শ্রীকান্ত, দত্তা, গৃহদাহ, পথের দাবী, পরিণীতা, শেষ প্রশ্ন ইত্যাদি শরৎচন্দ্র রচিত বিখ্যাত উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তার দরুন তিনি ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’ নামে খ্যাত। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উনিশশো তেইশ খ্রিষ্টাব্দে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক পান৷ এছাড়াও, তিনি উনিশশো ছত্রিশ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে ‘ডিলিট’ উপাধি পান।
তাঁর সমকালীন সময়ে ব্রাহ্মণ শাসিত এবং জমিদার শাসিত বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ কেমন ছিলেন তার নিখুঁত বর্ণনা আমরা তার লেখায় খুজে পাই। সমাজের সাধারণ মানুষই তার রচনার নায়ক। তাঁর জীবন অনুসন্ধানী দৃষ্টি আমাদের আকর্ষন করে। গল্পের কাহিনি পাঠককে একাগ্র করে তোলে । নারী চরিত্র নির্মানে তার ভূমিকা স্মরণীয়। প্রেমের বিশ্লেষন, আচার- আচরণের বর্ণনা তার রচনায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এখানেই তার বিশেষত্ব।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আঠারোশো ছিয়াত্তর খ্রিষ্টাব্দের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ পনেরোই সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের প্রেসিডেন্সি বিভাগের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
উনিশশো আটত্রিশ সালের ষোলই জানুয়ারী বাংলা সাহিত্যের এই অপরাজেয় কথাশিল্পী মৃত্যুবরণ করেন। তার রেখে যাওয়া সাহিত্য কর্মগুলোর মধ্যে অনেক কিছুই রয়েছে যা আমাদের হৃদয়ের মনিকোঠায় স্থান লাভ করে নিয়েছে। তার সাহিত্যে বিদ্যমান বেশ কিছু উক্তি আমরা আজকের এই দিনে একটু ফিরে দেখবার চেষ্টা করি।
* সমস্ত রমণীর অন্তরে নারী বাস করে কিনা তাহা জোর করিয়া বলা অত্যন্ত দুঃসাহসের কাজ। কিন্তু নারীর চরম সার্থকতা যে মাতৃত্বে এ কথা বােধ করি গলা বড়াে করিয়াই প্রচার করা যায়।
* বনের পাখির চেয়ে পিঞ্জরের পাখিটাই বেশি ছটফট করে।
* ভালাে বক্তার কাছে জনতা যুক্তিতর্ক চাহে না, যাহা মন্দ তাহা কেন। মন্দ এ খবরে তাহাদের আবশ্যক হয় না। শুধু মন্দ যে কত মন্দ অসংখ্য বিশেষণ যােগে ইহাই শুনিয়া তাহারা চরিতার্থ হইয়া যায়।
* যেখানে ফেলে যাওয়াই মঙ্গল সেখানে আঁকড়ে থাকাতেই অকল্যাণ।
* লােকে বলে, এই তাে দুনিয়া! এমনি ভাবেই ত সংসারের সকল কাজ চিরদিন হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু এই কি যুক্তি! পৃথিবী কি শুধু অতীতের জন্য, মানুষ কি কেবল তাহার পুরাতন সংস্কার লইয়া অচল হইয়া থাকিবে! নূতন কিছু কি সে কল্পনা করিবে না! উন্নতি করা কি তাহার শেষ হইয়া গেছে!
* কোনাে প্রেমই কোনােদিন ঘৃণার বস্তু হতে পারে না।
* আমাদের দেশের লােক বই পড়েন বটে, কিন্তু পয়সা খরচ করে কিনে পড়েন না।
* অর্থশালী পুরুষের যে কোনাে দেশেই বয়সের অজুহাতে বিবাহ আটকায় , বাংলা দেশে ত নয়ই।
* পৃথিবীর আকর্ষণ ত চিরদিনই আছে কিন্তু সে আকর্ষণে আত্মসমর্পণ করতে গাছের পাকা ফলটিই পারে, কঁচায় পারে না। তার আঁশ শাঁস পৃথিবীর রসেই পাকে, স্বর্গের রসে পাকে না। সুন্দর ফুল রূপ দিয়ে, গন্ধ দিয়ে, মধু দিয়ে, মৌমাছি টেনে এনে ফলে পরিণত হয়, সেই ফল আবার ঠিক সময়ে মাটিতে পড়ে অঙ্কুরে পরিণত হয়। এ তার প্রকৃতি, এই তার প্রবৃত্তি, এই তার স্বর্গীয় প্রেম। বিশ্বজুড়ে এই যে অবিচ্ছিন্ন সৃষ্টির খেলা, রূপের খেলা চলেছে, স্বর্গীয় নয় বলে এতে দুঃখ করবার বা লজ্জা পাবার ত কিছু দেখিনে।
* সন্তানের নামকরণকালে পিতামাতার মূঢ়তায় বিধাতাপুরুষ অন্তরীক্ষে থাকিয়া অধিকাংশ সময়ে শুধু হাস্য করিয়াই শান্ত হন না, তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাই অহাদের সমস্ত জীবনটা তাহাদের নিজেদের নামগুলোকেই যেন আমরন ভ্যাংচাইয়া চলিতে থাকে।
* নারীর এক জাতীয় রূপ আছে যাহাকে যৌবনের অপর প্রান্তে না পৌছিয়া পুরুষ কোনােদিন দেখিতে পায় না।
* ছেলে বয়সের একটা মস্ত দোষ এই যে, অনেক বই পড়ার অভিমানটা এদের পেয়ে বসে। তাই নিজের লেখার মধ্যে নিজের কিছুই থাকে না, থাকে শুধু মুখস্থ করা পরের কথা। থাকে কারণে অকারণে যেখানে সেখানে খুঁজে দেওয়া বিদ্যার বাচালতা।
* যারা অধর্মকে ভয় করে না, লজ্জা ভয় যাদের নেই, প্রাণের ভয়টা যদি তাদের তেমন বেশি থাকে, তা হলে সংসার ছারখার হয়ে যায়।
* সংসারে বন্ধু সংখ্যা যাহার অপরিমিত দুঃখের দিনে ডাক দিবার মতাে বন্ধুর তাহারি সবচেয়ে অভাব।
* স্পষ্ট করার লােভ যাদের বড় বেশি, বক্তা হলে তারা খবরের কাগজে বক্তৃতা ছাপায়, লেখক হলে নিজের গ্রন্থের ভূমিকা, আর নাট্যকার হলে তারাই সাজে নিজের নাটকের নায়ক।
* চটুল বাক্যের নানা অলঙ্কার গায়ে আমাদের জড়িয়ে দিয়ে যারা প্রচার করেছিল মাতৃত্বই নারীর চরম সার্থকতা, সমস্ত নারীজাতীকে তারা বঞ্চনা করেছিল।
* সর্বপ্রকার মতকেই শ্রদ্ধা করতে পারেন কে জানেন? যার নিজের মতের বালাই নেই। শিক্ষার দ্বারা বিরুদ্ধ মতকে নিঃশব্দে উপেক্ষা করা যায়।
* প্রায় কোনাে দেশেই পুরুষ নারীর যথার্থ মূল্য দেয় নাই।
* বিরাগ-বিদ্বেষ নিয়ে বিচার করতে গেলে কেবল একপক্ষই ঠকে না, অন্য পক্ষও ঠকে।
* যে সকল ব্যাপার সচরাচর এবং সহজভাবে ঘটে না এবং যাহার মধ্যে পাপ আছে, তাহা তলাইয়া বুঝিতে না পারিলেও সকলেই নিজের বুদ্ধি অনুসারে একরকম করিয়া বুঝিতে পারে।
* মনই যদি দেউলে হয়, পুরুতের মন্ত্রকে মহাজন খাড়া করে সুদটা আদায় হতে পারে, কিন্তু আসল ত ডুবল।
* যে লােক দাবী করতে ভয় পায়, পরের দাবী মেটাতেই তার জীবন কাটে।
* বড়াে দুঃখ ছাড়া কোনােদিন কোনাে বড়ড়া জিনিস লাভ করা যায় না।
* মনের বার্ধক্য আমি তাকেই বলি…যে মন সুমুখের দিকে চাইতে পারে
লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন এর সকল সদস্য, দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে প্রিয় এই মানুষটির জন্মবার্ষিকীতে জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।
তারিখঃ- ১৫/৯/২০২১ ইং।