প্রগতিশীল ও মানবতাবাদী ভাবধারায় তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন। মানুষ ও সমাজ ছিলো তার সাহিত্য ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর আদর্শবোধ ও প্রগতিশীলতা তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যে সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে।
বলছি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, গবেষক, সাহিত্য-সমালোচক আলাউদ্দিন আল আজাদের কথা।
উনিশশো বত্রিশ সালের ছয়ই মে নরসিংদী জেলার রায়পুর থানার রামনগর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সুসম্পন্ন করে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবন ও কবিতা বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন।
অরগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরে তিনি তুলনামূলক সাহিত্যে উচ্চ প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন। আলাউদ্দিন আল আজাদ অধ্যয়নকালে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক ও বার্ষিকী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা জেলা যুবলীগের সভাপতি ও পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সহসভাপতি ছিলেন।
পাকিস্তানের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা তাঁকে সাহিত্যচর্চায় অনুপ্রাণিত করে। দেশ বিভাগের পরে তিনি দেশের চলমান প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
অধ্যয়ন শেষে তিনি নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজ, ঢাকা জগন্নাথ কলেজ, সিলেট এমসি কলেজ এবং চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন। তিনি ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন এক বছর।
কিছুকাল মস্কোতে বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করার পর তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন।
এ ছাড়া তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল প্রফেসর ও নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আবির্ভাব। এ সময়ে যাঁরা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলার চেষ্টা করেন, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
প্রথম জীবনে গ্রামের মানুষ ও তাদের সংগ্রাম, প্রকৃতির ঐশ্বর্য ও সংহারমূর্তি দুইই তাঁর মনে ছাপ ফেলে গেছে। নগরজীবনের কৃত্রিমতা, রাজনীতিক সংগ্রাম, নিপীড়ন, প্রতারণা তিনি তাঁর কথাসাহিত্যের বিষয়বস্ত্ত করেছেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগন্থের মধ্যে রয়েছে জেগে আছি, ধানকন্যা, জীবন জমিন প্রভৃতি। ষাটের দশকে রচিত তাঁর উপন্যাস, তেইশ নম্বর তৈলচিত্র ও কর্ণফুলী ব্যাপক সাড়া জাগায়।
তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাসটির বিষয়বস্ত্ত অবলম্বনে বসুন্ধরা নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সুভাষ দত্ত। এ চলচ্চিত্রটি দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়।
তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে শীতের শেষরাত বসন্তের প্রথমদিন, ক্ষুধা ও আশা, শ্যামল ছায়ার সংবাদ উল্লেখযোগ্য।
তাঁর মরক্কোর যাদুকর, মায়াবী প্রহর ও ধন্যবাদ অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ নাটক। তাঁর অন্যান্য নাটকের মধ্যে ধন্যবাদ, নিঃশব্দ যাত্রা, নরকে লাল গোলাপ প্রধান। তাঁর দুটি কাব্যনাট্য, ইহুদির মেয়ে ও রঙিন মুদ্রারাক্ষস।
আলাউদ্দিন আল আজাদের সাহিত্য সমালোচনায় ও মননশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় শিল্পীর সাধনা, সাহিত্যের আগন্তুক ঋতু, নজরুল গবেষণা, ধারা ও প্রকৃতি, মায়াকোভস্কি ও নজরুল, সাহিত্য সমালোচনা প্রভৃতি গ্রন্থে।
আলাউদ্দিন আল আজাদের কাবগ্রন্থগুলির মধ্যে মানচিত্র, ভোরের নদীর মোহনায় জাগরণ, লেলিহান পান্ডুলিপি, নিখোঁজ সনেটগুচ্ছ, সাজঘর ও শ্রেষ্ঠ কবিতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আলাউদ্দিন আল আজাদ ভাষা আন্দোলনের গণমুখী ও স্বদেশপ্রেমী সাহিত্যধারার লেখক ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে প্রেরণাদীপ্ত দায়িত্ববান শিল্পীর ভূমিকা গ্রহণে উজ্জীবিত করে।
সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য আলাউদ্দিন আল আজাদ বেশসংখ্যক পুরস্কারে ভূষিত হন। তার মধ্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ইউনেস্কো পুরস্কার, জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার, একুশে পদক, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক উল্লেখযোগ্য।
দু’হাজার নয় সালের তেসরা জুলাই অর্থাৎ আজকের এই দিনটিতে ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সকল সদস্য দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।
তাংঃ- ৩/৭/২০২১ইং