বাঙালির অত্যন্ত প্রিয় চলচ্চিত্রাভিনেতা রবি ঘোষ যার পুরো নাম রবি ঘোষদস্তিদার যিনি বিভিন্ন চরিত্রে সাবলীলভাবে অভিনয় করলেও কমেডিয়ান হিসেবে তিনি সুবিখ্যাত। চলচ্চিত্র ছাড়াও নাটক ও দূরদর্শনের ছোট পর্দায় তিনি অভিনয় করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিরিজের সিনেমায় তাঁর চরিত্র সমস্ত বাঙালির মনে আজও অমলিন।
কোচবিহারে মামাবাড়িতে উনিশশো একত্রিশ সালের চব্বিশে নভেম্বর জন্ম হয় রবি ঘোষের। তাঁর বাবা জীতেন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদার বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালের বাসিন্দা হলেও কর্মসূত্রে থাকতেন কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটে থাকতেন। তাঁর মা জ্যোৎস্নারানি ছিলেন কোচবিহারের সুনীতি অ্যাকাডেমির বৃত্তি পাওয়া ছাত্রী। পাঁচ ভাইবোনের দ্বিতীয় ছিলেন রবি।
প্রথম স্ত্রী অভিনেত্রী অনুভা গুপ্তর সঙ্গে সম্পর্কের শুরু হাঁসুলিবাঁকের উপকথা ছবি করার সময়। সেই সময় হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন রবি ঘোষ। অনুভাদেবীর শুশ্রুষায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। নানা টানাপোড়েনের পর তাঁরা বিয়ে করলেও, উনিশশো বাহাত্তর সালে অনুভাদেবীর অকাল মৃত্যুতে সেই সম্পর্ক দীর্ঘ হয়নি। এই ঘটনার এক দশক পর উনিশশো বিরাশি সালে রবি ঘোষ বিয়ে করেন বৈশাখিদেবীকে।
পর্দায় অভিনেতা রবি ঘোষের যে রূপ দেখা যায়, ব্যক্তি হিসেবে একেবারেই তিনি তার বিপরীতের। একটি গুরুগম্ভীর মানুষ, যিনি সময় পেলেই রামকৃষ্ণ কথামৃত পড়ে সময় কাটাতেন। আর পড়তেন প্রবন্ধ-নাটকের নানা বই। প্রথম জীবনে কমিউনিজিমে দীক্ষিত হয়ে নিজে পূজার্চনা না করলেও অন্যের বিশ্বাস-ভক্তিকে কখনও ছোট করেননি। মাঝে মধ্যে অবশ্য কৌতুকের ভঙ্গিমায় বলতেন— আমাকে রসেবশে রাখিস মা! পরচর্চা-পরনিন্দা করে সময় নষ্ট করতেন না, এমনকী খারাপ শব্দও ব্যবহার করতেন না কখনও।
আড্ডাবাজ, পরোপকারী মানুষটি খেতে ভালবাসলেও খুবই পরিমিত আহারে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রিয় খাবার ছিল লুচি ও পাঁঠার মাংস। ভালবাসতেন লোককে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে। তবে, গোল বাঁধত যখন তা বাড়িতে জানাতে ভুলে যেতেন। সন্ধে বা রাতে বাড়িতে অতিথি এসে উপস্থিত হলে খুবই গম্ভীর হয়ে তাঁদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলতেন। সময়ে-অসময়ে এ ভাবেই অবস্থার সামাল দিতেন এই ‘মজার’ মানুষটি ।
অভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ ছাত্রজীবনেই শুরু, ‘বন্ধুমন’ নামে একটি নাটকের দল গড়ে মহড়া দিতেন আশুতোষ কলেজের ছাদে। নাটকের জন্য বহুবার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হতে হয়। অভিনয় করা তাঁর বাবা একেবারেই পছন্দ করতেন না তবে মা ও বড়মামার সমর্থন ছিল পুরোপুরি।
অভিনয় জীবন শুরু পাঁচের দশকে ‘সাংবাদিক’ নাটক দিয়ে, পরিচালক উৎপল দত্ত। নাটকে রবি ঘোষের চরিত্র ছিল এক জন সংবাদপত্র বিক্রেতার, মঞ্চের এক দিক দিয়ে ঢুকে অন্য প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ছিল তাঁর ভূমিকা। কলেজের বন্ধু অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শেই উৎপল দত্তের নাটকের দল লিট্ল থিয়েটার গ্রুপ-এর সংস্পর্শে আসা।
উৎপল দত্তের পরিচালনায় এলটিজি-র নিবেদিত ‘অঙ্গার’ নাটকে অভিনয় করেন রবি ঘোষ। অঙ্গারে অভিনয় করার জন্য উনিশশো ষাট সালে উল্টোরথ (শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেতা) পুরস্কারও লাভ করেন। উল্লেখ্য, এই নাটকের প্রথম শো-এর পাঁচ দিন আগে পিতৃহারা হন রবি কিন্তু ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ সরিয়ে রেখে অভিনয়ের ডাকেই সাড়া দিয়েছিলেন তিনি। এমনই ছিল তাঁর পেশাদারিত্ব।
উৎপল দত্ত পরিচালিত নাটক বাদ দিলে কেবলমাত্র অভিনেতা-বন্ধু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ঘটক বিদায়’ নাটকে অভিনয় করেন রবি ঘোষ।
তিনি দুই শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন, তার মধ্যে অভিযান, গল্প হলেও সত্যি, গুপী গাইন বাঘা বাইন, অরণ্যের দিনরাত্রি, হীরক রাজার দেশে, গুপী বাঘা ফিরে এলো, পদ্মা নদীর মাঝি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সত্যকাম, সব সে বড়া সুখ, আজ কি রবিনহুড, পতঙ্গ ইত্যাদি হিন্দি সিনেমাতেও তিনি অভিনয় করেন।
তিনি বেশ কয়েকটি যাত্রাপালাতেও অভিনয় করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাল্কি চলে রে, বিয়ে পাগলা বুড়ো, লাট সাহেবের নাতজামাই, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল। দূরদর্শনের বিভিন্ন ধারাবাহিকেও অভিনয় করেছেন যেমন দূরদর্শনে ধারাবাহিক গোয়েন্দা ভগবান দাস, হুতোমের নকশা, ফেলুদা ৩০, গোপাল ভাঁড়, মনোরমা কেবিন ইত্যাদি।
অভিনয়ের জন্য রবি ঘোষ জীবনে অনেক পুরস্কার লাভ করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ এর জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, ‘গুপীবাঘা ফিরে এল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন এওয়ার্ড, ‘নয়নতারা’র জন্য আনন্দলোক পুরস্কার ইত্যাদি। উনিশশো সত্তর সালে তিনি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির মুখ্য চরিত্র হিসেবে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ।
বাংলা সিনেমা জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাস্যকৌতুক অভিনেতার উনিশশো সাতানব্বই সালের আজকের এই দিনে অর্থাৎ চৌঠা ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়।লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন এর সকল স্তরের সদস্য দায়িত্বশীল এবং শুভাকাঙ্ক্ষীবৃন্দের পক্ষ থেকে প্রিয় এই অভিনেতার মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অজস্র ভালোবাসা।
তারিখঃ- ৪/২/২০২১ ইং।